২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
চা কারখানায় কাঁচা পাতা কিনতে টালবাহানা

তেঁতুলিয়ার ৫ হাজার চা চাষির মাঝে হতাশা

তেঁতুলিয়ায় সমতল ভূমির চা বাগানে পাতা তুলছে নারী শ্রমিকরা : নয়া দিগন্ত -

তেঁতুলিয়ায় চা কারখানাগুলো সবুজ কাঁচা পাতা কিনতে নানারকম টালবাহানা শুরু করায় চা চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। শতকরা ৩০-৪০ ভাগ লেস (কর্তন) করে চাপাতা বিক্রি করায় চাষিরা বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে,দেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়ায় সর্বপ্রথম স্বল্প পরিসরে সমতলে চা আবাদ শুরু করে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড (টিটিসিএল)। পরে এখানে বৃহৎ পরিসরে চাচাষ শুরু করে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড। একপর্যায়ে বিকাশ বাংলাদেশ নামের একটি কোম্পানি চা চাষে উৎসাহ দিতে ক্ষুদ্র চা চাষিদের বিনা সুদে চা চারা প্রদান করে। তখন থেকেই চা আবাদে সাধারণ চাষিদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ফলে শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলের জমিতে চা আবাদ শুরু হয়। তেঁতুলিয়া এখন ছোট বড় চাবাগানে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বর্তমানে আখ ও আনারসের আবাদ কমলেও সমতল ভূমিতে ব্যাপকভাবে সুবজ চাচাষ হচ্ছে। সিলেট ও চট্টগ্রামের পর তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছে। সেই সাথে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা আবাদ দেশের মূল অর্থনীতিতে নতুন এক মাত্রা যোগ করছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় অফিসের তথ্য মতে, তেঁতুলিয়া, সদর, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলাসহ গোটা জেলায় দুই হাজার ২৬৫ হেক্টর সমতল ভূমিতে সবুজ চাচাষ হচ্ছে। এর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলা শীর্ষে। পঞ্চগড় অফিসের সমীক্ষা অনুয়ারী তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়ে নিবন্ধনকৃত বড় চা বাগানের (২০ একর জমির ঊর্ধ্বে নয়) সংখ্যা সাতটি এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় আরো একটি বাগান আছে। পঞ্চগড় অফিসের অধীনে নিবন্ধনকৃত চা চাষির সংখ্যা ৮১২ জন। এ ছাড়া ক্ষুদ্র চা চাষির সংখ্যা প্রায় চার হাজার।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের অধীনে পঞ্চগড় জেলায় অনুমোদিত ২১টি চা কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি কারখানা পুরোদমে কাজকর্ম চালাচ্ছে। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও জেলায় আরো একটি চা কারখানার অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন আছে। অনুমোদনকৃত কারখানাগুলোর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় টিটিসিএল টি ফ্যাক্টরি, গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রো লিমিটেড টি ফ্যাক্টরি, ফাবিহা টি ফ্যাক্টরি, বাংলা টি ফ্যাক্টরি, ইমপেরিয়াল টি ফ্যাক্টরি কাজী অ্যান্ড কাজী টি ফ্যাক্টরি এবং পঞ্চগড় সদর উপজেলায় নর্থ বেঙ্গল টি ফ্যাক্টরি, মৈত্রি টি ফ্যাক্টরি, মরগেন টি ফ্যাক্টরি, সাজেদা রফিক টি কারখানা, উত্তরা টি ফ্যাক্টরি, করতোয়া টি ফ্যাক্টরি, নাহিদ টি ফ্যাক্টরি ও মলি টি ফ্যাক্টরিতে পুরোদমে চা প্রসেসিং শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি, রয়েল টি ফ্যাক্টরিসহ আরো একাধিক চা কারখানার নির্মাণকাজ চলমান আছে।
এসব কারখানায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাষিরা প্রতি কেজি সবুজ চা পাতা ২৫ থেকে ৩০ টাকা হারে বিক্রি করে থাকেন। আগে নিলামে দাম বেশি থাকায় ফ্যাক্টরির মালিকরা উৎপাদন অব্যাহত রাখতে চাষিদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা পর্যন্ত দরে সবুজ চাপাতা কিনেছেন। সবুজ চা পাতার দাম আকস্মিক বৃদ্ধিতে সাধারণ চাষিরা বসতবাড়ির আশপাশে বাঁশ ঝাড়, কাঠ গাছের বাগান, আমের বাগান ইত্যাদি নষ্ট নতুন নতুন চাবাগান সৃজন করেছেন।
মাগুড়া গ্রামের ক্ষুদ্র চাচাষি আব্দুল লতিফ বলেন, ২০১৬ সালে কলা বাগানে ভেঙে চার বিঘা জমিতে চাবাগান করেছি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি ৪৫ দিনে (এক রাউন্ড) জমি থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকার চাপাতা বিক্রি করেছি। অথচ বর্তমানে কারখানা মালিকেরা চাপাতা কিনতে নানারকম টালবাহানা করছেন। ক্ষেতের সবুজ পাতা শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ লেস (কর্তন) দিয়ে প্রতি কেজি ১৪ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাতা কেনার টালবাহানার বিষয়ে জনপ্রতিনিধি বা জেলা প্রশাসক কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। ফলে চা ফ্যাক্টরির মালিকরা অনেকটা খেয়াল খুশিমতো চাষিদের পাতা কিনছেন। যে কারণে চাবাগান যেন চাষিদের খুশির বদলে বিষাদের কারণে পরিণত হয়েছে
আজিজনগর গ্রামের চাচাষি আলমগীর মিঞা বলেন, আমি পাঁচ একর জমিতে চাবাগান করেছি। কিন্তু বাগানের পাতা বিক্রির জন্য কারখানাগুলোতে গেলে সিরিয়াল দিচ্ছে না। আর যদিও সিরিয়াল দেন তখন দাম শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ কর্তন করেন। ফলে প্রতি কেজি ১৪ টাকা দরে বিক্রি করে কৃষককে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতে হয়।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান (ডাবলু) বলেন, কারখানার মালিকদের একতরফা সিদ্ধান্তে চা চাষিদের পাতা বিক্রয়ে ভোগান্তি বেড়েছে। এই ভোগান্তি অনেকটা নীল চাষিদের মতো। কারণ অন্যান্য ফসলের জমিতে কৃষকেরা চাবাগান করেছেন। বর্তমানে কৃষকরা বাগানের পাতা বিক্রি করতে না পারায় সার্বিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় অফিসের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সবুজ কাঁচা পাতার (সাড়ে চার পাতা) মূল্য সরবরাহ কমিটি কর্তৃক দাম ১৪ টাকা কেজি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কারখানাগুলো মনিটরিং করে দেখা যাচ্ছে চাষিরা ৮ থেকে ১০ পাতা যুক্ত সবুজ কাঁচা চাপাতা সরবরাহ করছেন। চাষিরা মানসম্মত পাতা সরবরাহ না করায় কারখানার মালিকরা পাতা কেনায় গড়িমসি করছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবগত করা হয়েছে। তিনি যতদ্রুত সম্ভব তদারকি কমিটি গঠনের মাধ্যমে চাষিদের ক্ষতির বিষয়টি সুরাহা করবেন বলে জানিয়েছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement