২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যাকে এশিয়ার সবচেয়ে অসুস্থ কোভিড রোগী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল চিকিৎসকরা

- সংগৃহীত

স্টিভেন ক্যামেরন যখন নিজের জন্মভূমি স্কটল্যান্ড থেকে ১০হাজার মাইল দুরের দেশ ভিয়েতনামে কোভিড-১৯ এ ঘায়েল হন, ডাক্তাররা এক পর্যায়ে বলে দেন তার বাঁচার আশা বড়জোর ১০ শতাংশ।  মি ক্যামেরনের শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে ঢোকানো হয়। দু মাসেরও বেশি সময় তিনি সেখানে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন।

‘আমার দেহের নানা জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। শরীরের দুটো প্রত্যঙ্গ কাজ করছিলো না। ফুসফুসের ক্ষমতা এক পর্যায়ে ১০ শতাংশে নেমে গিয়েছিল,’ বিবিসিকে বলছিলেন স্টিভেন ক্যামেরন। তার শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ভিয়েতনামের সরকার, চিকিৎসক সমাজ থেকে শুরু করে সেদেশের মিডিয়া পুরো সময়টি ধরে তার ওপর নজর রেখেছিল।
‘আমাকে বলা হয়েছিল আমি এশিয়ার সবচেয়ে অসুস্থ রোগী হয়ে পড়েছিলাম।’

করোনাভাইরাস প্যানডেমিক চলাকালে স্টিভেন ক্যামেরনের মতো এত জটিল কোভিড রোগী ভিয়েতনামের ডাক্তারদের সামলাতে হয়নি। ৪২ বছর বয়সী এই স্কটিশ নাগরিক ভিয়েতনামে রোগী-৯১ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তার ডাক্তাররা বলছেন, বেঁচে গেলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে তাকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

‘ভুলেও হেলাফেলা করবেন না’

মি. ক্যামেরন এখন মানুষকে সাবধান করেন, ভুলেও যেন তারা এই ভাইরাসকে হেলাফেলা না করেন।

‘এই ভাইরাস যে কতটা ভয়ঙ্কর আমি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ,’ স্কটল্যান্ডে একটি হাসপাতালের বেড থেকে বিবিসিকে বলেন তিনি।
‘এই ভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত মানুষ যেন কখনই এটাকে হেলাফেলা না করে।’

যেদেশ থেকে তিনি বেঁচে ফিরেছেন, সেই ভিয়েতনাম এতটাই সতর্ক ছিল যে এখনও একজনও সেখানে কোভিডে মারা যায়নি। কিন্তু সেখানকার উপকূলীয় শহর দা নাং-এ দুদিন আগে চারজন কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৮০হাজার পর্যটককে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

মৃত্যুর প্রস্তুতি চলছিল

মি. ক্যামেরন যতদিন অচেতন ছিলেন, অধিকাংশ সময় তাকে ‘একমো’ নামে বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হলেই এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে রোগীর শরীর থেকে রক্ত বের করে তাতে অক্সিজেন মিশিয়ে আবার তা শরীরে ঢোকানো হয়।

‘এক পর্যায়ে আমার বন্ধু ক্রেইগ (ব্রিটিশ) পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানায় আমার বাঁচার সম্ভাবনা ১০ শতাংশ। সে আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়ার চুক্তি বাতিল করে দেয় , এবং আমার শবদেহ নিয়ে কী করবে তার পরিকল্পনা করতে শুরু করে দেয়,’ জুন মাসে হো চি মিন-এর হাসপাতাল থেকে বিবিসিকে বলেছিলেন স্টিভেন ক্যামেরন।

খুব অল্পের জন্য দ্বিতীয়বারের মত ফুসফুস বদলানোর হাত থেকে রক্ষা পান মি. ক্যামেরন। এক পর্যায়ে তার শরীরের একাধিক যন্ত্র কাজ করছিলোনা।

‘ভিয়েতনামের কাছে আমি কৃতজ্ঞ’

কিন্তু মি. ক্যামেরন মনে করেন তার সৌভাগ্য যে তিনি ভিয়েতনামে অসুস্থ হয়েছিলেন। কারণ সাড়ে নয় কোটি মানুষের দেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪২০ জন কোভিড রোগী সেখানে শনাক্ত হয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিতে হয়েছে, এবং এখনও একজনও মারা যায়নি।

‘পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় এমন অসুস্থ হলে আমি মারা যেতাম। তার ৩০ দিন পরেই ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করে দিত। ভিয়েতনামের মানুষ আমাকে যেভাবে তাদের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে, আমি তার জন্য ভীষণ কৃতজ্ঞ। তাদের ডাক্তাররা কোনোভাবেই চাননি যে আমি তাদের চোখের সামনে মারা যাই। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

‘এ যেন একের পর এক আলট্রা ম্যারাথন দৌড়ানো’

স্কটল্যান্ডে ফেরার পর তার ফলো-আপ চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছেন শ্বাসযন্ত্র রোগের বিশেষজ্ঞ ড. মনিশ প্যাটেল। তিনি বলছেন মি. ক্যামেরন যে এত দীর্ঘ সময় ধরে অচেতন থাকার পরও প্রাণে বেঁচেছেন - সেটা ‘খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা।’

‘মানুষ বলে ইনটেনসিভ কেয়ারে ঢোকা মানে ম্যারাথন রেস শুরু। সেই বিচারে স্টিভেন কয়েকবার আলট্রা-ম্যারাথন রেস দিয়ে এসেছেন,’ বিবিসিকে বলেন ড.প্যাটেল। হো চি মিনের হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে থাকার সময় দু মাসেই তার শরীরের ওজন ৩০ কেজি কমে যায়। স্কটল্যান্ডে তার শরীরের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চললেও এখনও তিনি হাঁটতে পারছেন না।

‘আমি যখন প্রথম চেতনা ফিরে পেলাম আমার ভেতর আতঙ্ক এস ভর করে - আমি কি আর কখনো হাঁটতে পারবো! আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার প্যারালাইসিস হয়েছে কিনা, কারণ আমি পায়ে কোনো সাড় পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধ আর কখনই বিমান চালাতে পারবো না,’ বলেন মি ক্যামেরন।

তার এখন লক্ষ্য আগামী বছরের শুরুতে আবার বিমান চালানো। কিন্তু তার শরীরের অবস্থা তার পাইলট পেশাকে গভীর ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

নতুন সংক্রমণ

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল দেশগুলোর অন্যতম ভিয়েতনাম। তবে এ সপ্তাহে পর্যটন শহর দা নাং-এ নতুন করে চারজন কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সেদেশে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিদেশ থেকে কেউ এসে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনো নেই। ফলে সেটি ভিয়েতনামের সরকারের জন্য একটি দুঃসংবাদ, বলছেন ব্যাংককে বিবিসির জনাথন হেড। তিনি বলেন, দা নাং এ কম্যুনিটি সংক্রমণ ছড়ানোর আশংকা দেখা দিয়েছে।

ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী দা নাং শহরে সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ আরোপের নির্দেশ দিয়েছে। জরুরী নয় এমন সমস্ত সেবা বন্ধ করা হয়েছে। ১৪ দিনের জন্য ঐ শহরে পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তবে এখনও দা নাং শহরটি পুরোপুরি লকডাউন করা হয়নি।

জনাথন হেড বলছেন, কোভিড-১৯ এর হুমকি মোকাবেলায় একদম শুরু থেকেই ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট সরকার খুবই তৎপর ছিল। যেখানেই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, পুরো কম্যূনিটিকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। তবে পাশের দেশ থাইল্যান্ডের মতই ভিয়েতনামও দ্রুত গণহারে কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করেনি।

বদলে, এই দুই দেশই কম্যূনিটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সীমান্তে কড়াকড়ির পথ নিয়ে ভাইরাস মোকাবেলার পথ নেয়, যদিও দুটো দেশের অর্থনীতিই পর্যটনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement