২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সময়

সময় - প্রতীকী ছবি

‌১৯৯২ সালের কথা ৷ আমার বান্ধবী পিংকীর আম্মু ৷ আমার বড় মেয়ে সান শাইন স্কুলে (দনিয়া) ভর্তি সেই সূত্রে পিংকীর আম্মুর সাথে আমার পরিচয়৷ চিকন গড়ন, ফর্সা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমন স্মার্ট শিক্ষিত, কথায় নম্র ভদ্র মুখে হাসি, শাড়ির ওপর ওড়না মাথায় সবসময়৷ দুজনেই বাচ্চা নিয়ে স্কুলে আসি৷ অভিভাবক সারিতে দাঁড়াই কথা বলি। আস্তে আস্তে উনার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা একটু বেড়ে যায়। কিন্তু উনার ছিল স্বাধীন সংসার। অর্থাৎ তার সংসারে স্বামী স্ত্রী দুই বাচ্চা৷ আমার ছিল পরাধীন সংসার ৷ শ্বাশুড়ির সংসারে আমি৷ আমি ইচ্ছে করলেও কারো বাসায় যেতে পারতাম না, কাউকে আসতেও বলতে পারতাম না৷ স্বামী থাকতেন বিদেশে, আবার আব্বা-আম্মাও ছিলেন না৷ অতএব শাশুড়ি ছিলেন আমার একমাত্র অভিভাবক। তাই উনি যা পছন্দ করতেন, সেভাবেই দিন যাপন করতাম ৷ আমার ওই বান্ধবী ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। আমি পারতাম না৷ নিজের মতো করে সংসার ঘুছিয়েছেন৷ স্কুলের সাথে তার বাসা৷ একদিন তার বাসায় আমাদের কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে গেলেন ৷ খুবই সুন্দর বাসা ৷ সোফার সাথে ম্যাচ করা কভার সাথে বালিশ, দরজা জানালার পর্দা গলো ঝকঝক করছে ৷ দুটি ফ্রিজ, একটা বড় ডিপফ্রিজ আরেকটা রিফ্রেজারেটর ৷ কাঠের ফার্নিচার গুলো সবেমাত্র বার্নিশ করা৷ বেশ পরিপাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গোছানো৷ যখন যা ইচ্ছে কিনে নিয়ে আসতেন৷ একটা শোকেজ ভর্তি শোপিস, আরেকটা ভরা তৈজসপত্রে ৷ বাচ্চা দুটি বেশ পরিপাটি, সুন্দর পোশাকে সাজিয়ে রাখেন৷ বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সচেতন ৷ বড় মেয়ে স্কুলে ফার্স্ট হতে লাগল এবং ছেলেকেও সেইভাবে প্রস্তুত করছেন, বাচ্চাদের তিনি নিজেই পড়াতেন৷ খুব আদর যত্ন করে লালন পালন করতেন ৷ পিংকি এক নম্বর কম পেলে খুব মন খারাপ করতেন, পরের পরীক্ষায় তাকে যেভাবেই হোক ফার্স্ট হতেই হবে। আমরাও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়েই মেয়েদের পড়াতাম। সে যাই, হোক স্বামী সন্তান নিয়ে সুন্দর সংসার ৷
ওই সময় হাতে আমাদের এলাকায় ছিল গোনা কয়েকটা ফ্ল্যাট বাসা৷ ফ্ল্যাট বাসা থাকা মানে বিশেষ কিছু। বান্ধবীর স্বামী ছিলেন ব্যবসায়ী৷ যাই হোক, বাসায় নিয়ে তিনি আমাদের অনেক আপ্যায়ন করলেন। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, আমি যদি ওনার সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হই, তা হলে তো তাদেরকেও আমার বাসায় নিতে হবে ৷ আমার স্বামী তখন বিদেশে, বাড়ি ভাড়া আছে। সব মিলিয়ে টাকা আছে, কিন্তু নাই স্বাধীনতা ৷ আমার বাসায় যেতে চাইলে আমি তাদের কী দিয়ে আপ্যায়ন করব?

ফলে আমি তাদের সবার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতাম, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে চলে আসতাম, আবার ছুটির পাঁচ মিনিট আগে যেয়ে নিয়ে আসতাম৷ স্কুল বাসায় থেকে কাছে। হাঁটার রাস্তা। তারপরও আমি কমই স্কুলে যেতাম। আমার শাশুড়ি মা প্রথম দিকে বেশি আনা নেয়া করতেন। মাঝে মাঝে আমি যেতাম। সেখানেই পিংকির আম্মু আমার সাথে মিশতে চাইতেন ৷ আমি যতই পাশ কাটিয়ে চলে আসি, ততই তিনি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চান ৷ একদিন খোঁজ করে আমার বাসায় চলে এলেন ৷

আমি তো দেখে অবাক। কী আর করা। মুখে হাসি দিয়ে ভেতরে আসতে বললাম ৷ সুন্দর মানুষ দামি একটা শাড়ি ম্যাচিং ব্লাউজ হালকা লিপিস্টিক, পায়ে সুন্দর স্যান্ডেল, ম্যাচিং ওড়না মাথায় ঘুমটা দেয়া, সুন্দর হাসি দিয়ে আমার দরজায় সাথে আরেকজন ৷ দুজনকে ঘরে ঢুকালাম মনে মনে ভয় ও পাচ্ছিলাম ৷ তেমন কিছু নাস্তা দিতে পারিনি, কেন সেই কথা আর না বলি ৷ তবু্ও কেন জানি আমাকে এত বেশি পছন্দ করতেন আমি নিজে ও জানতাম না ৷ তারপর থেকে মাঝে মধ্যে আসতেন আমার বাসায় ৷
সান শাইন শেষ করে বাচ্চাকে একে স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করালাম। আবার দুজনে একসাথে ৷ তখন বেশি একটা দেখা হতো না ৷ আস্তে আস্তে দেখা হওয়া বন্ধ প্রায় এক বছর ৷ আমার ছোট মেয়েকে ভর্তি করালাম সান শাইন স্কুলে৷ যৌথ পরিবার হওয়ায় আমার ব্যস্ততা সংসারে বেশি ৷ কিভাবে যেন জানতে পারলাম, তিনি আগের সেই বাসায় নেই ৷ অন্য বাসায় চলে গেছেন ৷ তার বাসার ঠিকানা জানি না ৷ কেউ বলতে পারে না, তিনি কোথায় থাকেন ৷ অনেক খোঁজ করতে লাগলাম ৷ স্কুলের দপ্তরির কাছে জানতে পারলাম, পিংকীর ছোট ভাই এই স্কুলে পড়ে, আমার মেয়ের এক ক্লাস ওপরে ৷

পিংকীর আম্মুর প্রতি আমার অনেক মায়া জন্মে গিয়ে ছিল। অনেক খুঁজে তার বাসা বের করলাম৷ ছোট একটা বাসায় উঠেছে৷ বাসাটা অন্ধকার৷ আগের সব আসবাবপত্র বিক্রি করে ফেলেছেন, পর্দাগুলো মলিন হয়ে গেছে, ঘরটা নিঃস্প্রাণ হয়ে আছে, সেই জৌলুশ নেই ৷ কয়েক বছরের ব্যবধানে মানুষ এতটা পরিবর্তন হতে পারে?
দূরাবস্থার জানালেন, 'পিংকীর আব্বুর ব্যবসায় অনেক লোকসান হওয়ায় এখানে উঠেছি ৷' আর্থিক দৈন্যতা তাকে ঘিরে ফেলেছে ৷ একটা সময় তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সমাজের অন্তরালে, অর্থ ও প্রাচুর্যের সাথে হারিয়ে গেল মনের আনন্দ ৷ আড়াল করতে লাগলেন প্রিয় মানুষদের ৷

‌অনেকক্ষণ তার সাথে সময় কাটালাম৷ আমি জানি, তিনি সেলাইকাজ ভালো জানেন , আমিও সেলাই জানি৷ তাকে পরামর্শ দিলাম সেলাই কাজ ঘরে বসে করা যায়, উপার্জনও ভালো৷ সেলাই কোন সমস্যা হলে আমি সমাধান করে দিব ৷ আপনি হাতে এমব্রয়ডারি খুব ভালো জানেন, তা দিয়ে শুরু করেন। আর টেইলারিং কাজ তো আমি জানি। আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।'

তারপর থেকে পাঞ্জাবি এমব্রয়ডারি কাজ শুধু করেন ৷ ওই সময় হাতে কাজ করার রুমালের প্রচলন ছিল ৷ আমার কাছ থেকে ছোট কাপড় নিয়ে সুন্দর হাত রুমাল বানাতেন৷ টুপি বানিয়ে চারপাশে হাতে কাজ করে বিভিন্ন শোরুমে দিতেন ৷ হাতের কাজের নিপুণতা আরো বেড়ে যাওয়ায় জামায় এমব্রয়ডারি কাজের অর্ডার পেতে শুরু করেন ৷ কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেল আয়ও ভালো হতে থাকে। কাজের ব্যস্ততা উনি আমার বাসায় আসতে পারে না৷ তখন আমি একটু স্বাধীন, খুব কম হলেও তার বাসায় যেতাম, তার সেলাই দেখতে খুব ভালো লাগত ৷

এভাবে কয়েক বছর পার হয়ে গেল, আবারো বাসা পরিবর্তন৷ আবারো আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল৷ তার জন্য মন খুব কাঁদে ৷ মনে মনে অনেক খুঁজি। কিন্তু বাসা থেকে কম বের হওয়ায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারি না, তার খবর নিতে পারি না ৷ একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পরিচিত একজনের সাথে দেখা হলে, পিংকীর আম্মুর কথা জানতে পারলাম। তার এক ছেলে হয়েছে। পাটেরবাগ থাকেন ৷ আমার সাংসারিক ব্যস্ততায় আর যোগাযোগ করতে পারিনি ৷ দীর্ঘ ১০ বছর আমার বাসায় দরজায় কড়া নড়ছেম আমি দেখে অবাক। প্রথম দিনের মতো বয়সের সাথে সৌন্দর্য কমে গেছে। কিন্তু সেই হাসিটা আছে৷ জানতে পারলাম, দুই বাচ্চার ১০ বছর পর ছেলে হয়েছে। ছেলের বয়স তিন/চার মাস ৷ অনেক দিন পর দেখা হয়ে দুজনে প্রাণ খুলে কথা বললাম ৷ কথাপোকথনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, তার আবার বাচ্চা পেটে ৷ আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো ৷ কয়েক বছর অনেক কঠিন অবস্থা ছিল ৷ সেই দুরাবস্থা কাটিয়ে এখন মোটামুটি ভালো ৷

‌কয়েক মাস পর জানতে পারলাম, তার আবার ছেলে হয়েছে, সিজার করে। কিন্তু ঘা শুকাচ্ছে না ৷ জায়গাটি ফুলে গেছে ৷ গেলেন ডাক্তারের কাছে, ওষুধ দিলেন কয়েক দিন খেলেন। কিন্তু কিছুতেই সেলাই শুকাচ্ছে না, বরং আরো বেড়ে গেছে ৷ আবারো ডাক্তারের কাছে গেলেন ৷ ডাক্তার তাকে কতগুলো পরীক্ষা করতে দিলেন ৷ রিপোর্ট নিয়ে গেলেন, রিপোর্ট দেখে ডাক্তার চিন্তিত ৷

'কী হয়েছে আমার?'
'তেমন কিছু না, আপনি ভালো আছেন,' ডাক্তার জানালেন।
আরেকটা টেষ্ট দিয়ে বললেন, এটা এখনই করতে দিয়ে আসেন ৷
সিষ্টার অন্য কক্ষে নিয়ে গেলেন টেস্টের নেয়ার জন্য ৷ ডাক্তার তার স্বামীকে জানালেন, তার লিকোমিয়া ৷ দ্বিতীয় ধাপে ৷

আস্তে আস্তে খবর ছড়াতে থাকে এবং আমার কানে আসে ৷ আমি জানতে পেয়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম, আল্লাহ তোমি আমাকে কী শোনালে! আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি শাশুড়ি মাকে বলে একদিন তাকে দেখতে যাই৷ ছোট দুই বাচ্চা একজনের বয়স ১৪ মাস আর একজন ১ মাস। আল্লাহর কী পরীক্ষা৷ এত বছর পর কেনই বা দুই বাচ্চা দিলেন, কেনই এরকম অসুখ দিলেন ৷ আল্লাহ তুমি ভালো জানো ৷

আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন, 'এতদিন পরে এলেন।' আগের চেয়ে একটু বড় ঘরে আমাকে নিয়ে বসতে দিলেন। 'আমার ছোট বাচ্চা হওয়ার পর থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, সাত দিনের ওষুধ দিয়ে বলেছেন, ভালো হয়ে যাবেন কোনো চিন্তা করবেন না। আর লোকজন এসে আমাকে বলে, আমার নাকি ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে, মানুষ যে কোথায় থেকে এসব কথা পায়।'

‌আমি বুঝতে পারলাম, তিনি জানেন না তার কী অসুখ । আমি সেভাবে কথা বলতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে তিনি আমাকে ভরসার কথা জানালেন, 'বিক্রমপুর একটা নিম গাছের ভিতর থেকে পানি ঝড়ে পড়ছে। ওই পানি এক নিয়ত করে খেলে অনেক উপকার হয়। পিংকীর আব্বু সেখান থেকে পানি এনে দিয়েছে। এটা খেয়ে অনেক ভালো লাগছে। এবং ভালো হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।' তার চোখে মুখে প্রবল মনোবল ভেসে ওঠে।

'আমার আসলে কিছুই হয়নি। মানুষের কথায় আমি কান দেই না। নিমগাছের পানি সবটুকু খেলে সুস্থ হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ'- বার বার বলতে লাগলেন।

‌আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন। ঠিকমতো ওষুধ খাবেন, নিমগাছের পানি খাবেন। নানা কথায় অনেক সময় কাটালাম। বাসায় এসে তার আশার কথা কানে ভাসতে লাগল। নিজের অসুখের কথা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বেঁচে থাকার কত আকাঙ্ক্ষা।

‌তারপর তাকে আর দেখতে যেতে পারিনি। মনে অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল দেখার। কিন্তু পারিনি। কয়েক দিন পর জানতে পারলাম, তাকে মাদ্রাজ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে মনে অনেক আল্লাহকে ডেকেছি, কেঁদেছি, আল্লাহ তাকে দয়া করে সুস্থতা দান করুন।
অল্প কয়েক দিন পর স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম, পিংকীর আম্মু দেশে এসেছেন। অনেক অসুস্থ, মানে শেষ পর্যায়ে। নিজেকে অনেক সাহসী করে শ্বাশুড়ি মায়ের অনুমতি না নিয়ে ওই আপাকে বললাম, চলুন তাকে দেখে আসি৷' তিনি সম্মতি জানালেন।

চারজন একসাথে হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম পিংকীদের বাসার দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলাম লাশের খাট কাঁধে বহন করা বেশকিছু লোক। ভাবলাম, কেউ হয়ত মারা গেছেন। কিছু দূর এগোতেই দেখি পিংকীর বড়ভাই এবং তার বাবা। বুঝতে আর বাকি নেই, এই খাটিয়ায় শুয়ে আছেন আমার প্রিয় বান্ধবী, যাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলাম না ৷


আরো সংবাদ



premium cement