০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জীবন চাকা

-


‘ঘরে বসে বসে আর কত খাবি। কোনো কাজকর্মই করিস না। এই বুড়ো বয়সে তোর বাপটা আর কত কষ্ট করবে? সপ্তায় দুটি কিস্তি, পাওনাদাররাও আসে বাড়িতে।’
প্রতিদিন শুনতে হয় এসব কথা মায়ের মুখ থেকে। একই কথা বারবার শুনতে আর ভালো লাগে না।
তাই একজনের সাথে যোগাযোগ করে চলে আসি ঢাকায়, জুতার ফ্যাক্টরিতে।
প্রথমে সে বলেছিল এক মাস ফ্রি কাজ করে দিতে হবে, তার পর বেতন ধরবে। পরে শুনি দুই মাস ফ্রি কাজ করার পর বেতন ধরবে। তিন-চার দিন পরই বাড়িতে এসে পড়লাম। এ ছাড়া যখন যে কাজে যাই, সেই কাজ থেকেই ফেরত এসে পড়ি ভালো লাগে না বলে।
অবশেষে ঢাকার একটি মার্কেটে এক আত্মীয়ের প্যান্টের দোকানে কাজ ঠিক হলো। বাড়ি থেকে বারবার বলে দিয়েছে যাতে আমি বাড়িতে ফেরত না আসি।
চলে গেলাম মহাজনের বাসায়। মহাজন যেহেতু খালুর ভাই, তাই মামা বলে ডাকি। তাদের একটিই রুম, ভাড়া থাকে। তাদের পাঁচ-ছয় বছরের এক কন্যাসন্তানও আছে।
মামায় আমার জন্য রুম খোঁজ করতে লাগলেন। আশপাশে কোনো ব্যাচেলর রুম ভাড়া পাচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের রুমেই থাকতে হবে। তারা খাটে থাকবে আমি ফ্লোরে থাকব। খাটের দিকে পর্দা টাঙিয়ে দিলেন।
ঘুম থেকে উঠেই, ভোর সকালে ক’টি গ্যালন ও বড় পাঁচ লিটারের প্লাস্টিক বোতল নিয়ে চলে যাই খাবারের পানি আনতে। সেখানে বড় সিরিয়াল। তাই ভোরে যেতে হয়।
তবুও কিছুটা সিরিয়ালে পড়তে হয়।
তা নিয়ে রিকশায় চড়ে চলে আসি রুমে।
ব্রেকফাস্ট করেই চলে যাই দোকানে।
আমার লেখালেখি করার একটু অভ্যাস ছিল, পরে ভুলে যেতে পারি বলে তাই ডায়রিতে লিখে রাখি। কিন্তু দোকানের এক কর্মচারী আমার লেখালেখি পছন্দ করে না। লেখালেখি করি বলে মাঝে মাঝে আমার মাথায় ঠুয়া মারে।
একসময় আমার লেখার ডায়েরি গায়েব করে ফেলে। ডায়েরিটি খুঁজে পাচ্ছি না বলে আমার মাথাটি গরম হয়ে যায়। এত বছরের লেখাগুলো সব শেষ। তার পর নিজের মাথায় নিজেই থাপড়াতে থাকি। সবাই ভাবল, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। সান্ত্বনা দিয়ে আশপাশের কর্মচারীরা আমার পাগলামি থামায়।

মহাজনের এই কর্মচারী শনিআখড়া থেকে প্রতিদিনই দেরি করে দোকানে আসে জ্যাম থাকে বলে। সে নানা কারণে আমার সাথে তর্ক করতেই থাকে। আর ভলো লাগে না, যেন বাড়ি চলে যাই।
বাড়ি গেলেও তো ঠাঁই হবে না। মন তো মানছে না। তার সাথে আমার ঝগড়া হয়ে গেল, হলো খুব মারামারি।
তারপর দোকান থেকে রোডের দিকে চলে যাই। বাঁচার কোনো ইচ্ছে নেই এই দুনিয়ায়।
কারণ আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ছোটকালেও সবার কাছেই অবহেলিত ছিলাম, এখনো অবহেলিত। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আত্মহত্যা করব। কীভাবে করতে পারি তা ভাবতে ভাবতে মেইন রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হয়তো গাড়ি চাপায়, নয়তো ফাঁসি। এমন চিন্তা করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়ল আমার পায়ের নিচে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার একটি পৃষ্ঠার অংশ। পৃষ্ঠাতে তারিখ লেখা ছিল ১৩ আগস্ট ২০১২। সেখানে বড় করে লেখা ‘আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়’ পৃষ্ঠা উঠিয়ে পুরা লেখা পড়লাম।
লেখাগুলো পড়ে আমার মনটি ঘুরে গেল। আসলেই আমি এখন কতটা কষ্টে আছি তার চেয়ে বেশি কষ্টে আছে হাজার হাজার মানুষ। যারা আত্মহত্যা করে তারাই জানে কতটা কষ্টের মধ্যে রয়েছিল এই দুনিয়ায়। তবে আত্মহত্যা করা এক ধরনের বোকামি, ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপ।
তারপর দোকানে আসার পথে অপর দোকানের এক কর্মচারীর সাথে দেখা হলো। আমার মন খারাপ বলে জিজ্ঞেস করলেন, মন খারাপ কেন? আমি তাকে ঘটনাটি খুলে বললাম।

এই লোকটি মামার কাছে জানালেন। তার পর মামায় সেই কর্মচারীকে খুব শাসন করলেন। এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। কেমন করে বরখাস্ত করবেন?
কারণ তার মতো একজন কর্মচারী এই দোকানে থাকা দরকার। তার অভিজ্ঞতা ভালো, মুখে চাপাও আছে। তাই রেখে দিয়েছেন।
তবে এখন থেকে আমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবে না। কিন্তু কিছু দিন পর আবার খারাপ ব্যবহার শুরু করল।
আমি নীরবে সহ্য করে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় তাকে মেরে ফেলি।
একসময় আমার জ্বর আসে।
প্রচণ্ড কাশি। আমার কাশির জন্য মামা-মামী কেউ তারা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে আমার গলা টিপে ধরে রাখি, আমার দম যায় যায় অবস্থা হলে গলাটা ছেড়ে দিই।
কারণ আমার জন্য তাদের ঘুমের খুব সমস্যা হচ্ছিল।
পরের দিন ডাক্তার দেখালাম। টাইফয়েড হয়েছে। ওষুধ দিলো ডাক্তার। কিছু দিন পর আল্লাহর রহমতে সুস্থ হলাম।
অনেক দিন হয়ে গেল বাড়িতেই আছি। এক ঘনিষ্ঠ লোক বিদেশ থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘কী করো?’
‘কিছু করি না, আমি বাড়িতেই।’
‘বাপের হোটেলে বসে বসে কত খাবে। কিছু একটা করো। বাপটা বুড়ো হয়ে গেছে। মানুষ ঝালমুড়ি বিক্রি করেও তো সংসার চালায়।’
এভাবে আমাকে অনেক জ্ঞান দিলো।

আমার মন-মানসিকতা ভালো নেই।
তাই কিছু বললাম না। কিন্তু আমার অনেক কষ্ট লাগল তার কথা শুনে। আসলে, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। আবার মনে এসে পড়ল কুচিন্তা। এবার আত্মহত্যা করবই। আত্মহত্যা করার আগে একটি টিভি চ্যানেলকে ফোন দিলাম। মনের বেদনাদায়ক কথা বলেই আত্মহত্যা করব সিদ্ধান্ত নিলাম। ফোনটি রিসিভ হলো না। তার পর, ফুফাত ভাইকে ফোন দিলাম। সে আমাকে সান্ত্বনা দিলো। ফুফাত ভাই বলল, ‘আরে আমার চেয়ে তো তুই বেশি কষ্টে নেই। আমার বাপটা দুর্ঘটনায় মারা গেল, বড় ভাইও সংসারটা দেখছে না, ছোট একটা অবিবাহিত বোনও আছে, আমার। পড়াশোনার খরচ, টিউশনি করে সব চালাচ্ছি। এ ছাড়া আমি শারীরিক-মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ। সপ্তায় সপ্তায় ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। আমি আত্মহত্যা করার চিন্তা করি না। আর তুই নাকি সামান্য ব্যাপারে আত্মহত্যা করবি। তুই আইসা পড় আমার কাছে। আমাকে সঙ্গ দিবি। আমি তোরে দেখুম। ছোটখাটো চাকরির ব্যবস্থা করে দিমু।’

তার কথা শুনে আবার মনটি শীতল হয়ে গেল।
এখন দূরপ্রবাসে আছি। বেশির ভাগ সময় একা একা থাকি। মনের মতো মানুষ মিলে না বলে কারো সাথে মিশি না। এ ছাড়া, আমি ধূমপান করি না, যারা করে তাদের সাথে তেমন চলাফেরা করি না। আমার দেশ-বিদেশের তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবও নেই। মনের কথাগুলো কারো কাছে শেয়ারও করতে পারি না। অবসর সময়ে লেখালেখি করে সময় কাটাই। ভাবি জীবন এক অদ্ভুত রহস্যে ভরা গাড়ি। যা শুধু চলতেই থাকে। চলতেই থাকে। হয়তো ভালো হয়তো ভালো নয়। কিন্তু চলেই সে, যত দিন জীবন-চাকা থেমে না যায়।

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement