০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বোধোদয়

-

আজ কী যে ভ্যাপসা গরম পড়ছে! গরমে যেন প্রাণ যায় যায়। মানুষসহ সব প্রাণীর না জানি কত কষ্ট হচ্ছে! আমার দিনা মামনিটা স্কুলে গেছে। ওর না জানি আরো কত কষ্ট হচ্ছে!
ভাবতে ভাবতেই দিনা এসে পড়ল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মন খারাপ। কিছু একটা হয়েছে হয়তো।
দিনা ব্যাগ রেখে চুপচাপ বসে আছে। অন্যদিন ফিরেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে অথচ আজ চুপচাপ। কারোর সাথে কোনো কথাই বলছে না। আম্মুর ডাকেও সাড়া দিচ্ছে না। কতক্ষণ জোরাজুরির পরে মুখে বুলি ফুটল।
-আম্মু আজ আমার মন খারাপ। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে ওদের জন্য।
-কাদের জন্য মামনি?
-আমার বন্ধুদের জন্য। জানো ওরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে।
-ওদের কী হয়েছে মামনি?
-তা তো জানি না। শুধু জানি বমি করছে, মাথা ঘুরছে।
আমার বোকা মেয়েটা, এতে মন খারাপ করার কি আছে? বিকেলে আমরা ওদের দেখতে যাবো। অনেক ফল-ফলাদি নিয়ে যাবো, তুমি গল্প করবে। দেখো ওরা আবার সুস্থ হয়ে উঠবে।
দিনা এখনো চুপ করে আছে। হঠাৎ আম্মুর ছোঁয়ায় নড়ে উঠল।
-এখনো মন খারাপ করে থাকলে চলবে মামনি? আমরা তো ওদের দেখতে যাচ্ছিই।
দিনা হেসে বলল, আম্মু সত্যি যাবে?
হ্যাঁ, সত্যি যাবো।
এবার চলো হাতমুখ ধুয়ে নাশতা করবে।
দিনা ও তার আম্মু বিকেলে হাসপাতালে যায়। দিনার মতো অনেক ছোট ছোট বাচ্চা অসুস্থ হয়ে ভর্তি সেখানে। তিনি কিছুটা অবাক হলেন! হঠাৎ এত বাচ্চা কীভাবে অসুস্থ হলো? দিনার মন ভালো করতে এসে তার নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেল। ভাগ্যিস তার দিনা এখনো সুস্থ আছে। মনে মনে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলেন। অবশ্য মন খারাপ মেয়েকে বুঝতে দেননি। ঘুরেফিরে অসুস্থ বাচ্চাদের দেখলেন, সঙ্গে আনা খাবারগুলোও সবাইকে দিলেন। তবুও তার অস্থিরতা কাটল না।
অতঃপর, তিনি ডাক্তারের ডেস্কে গেলেন। মেডিক্যাল অফিসারের সাথে তার কিছু কথাও হলো। তার পর তিনি অসুস্থতার কারণ জানতে পারলেন। সব কিছু শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দিনাও বুঝতে পারল।
-আম্মু, ডাক্তার আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন। আমাদের স্কুলের সামনে কয়েকজন হকারোা ভ্যানে করে আইসক্রিম বিক্রি করেন। ওগুলো আবার বিভিন্ন রঙেরও আছে। তুমি নিষেধ করাতে আমি কখনো খাইনি, এমনকি বন্ধুরা জোর করলেও না।
হাসপাতাল থেকে আসার পরে দিনার আম্মু আরো সচেতন হন। মেয়েকে বাইরের খাবার একদম খেতে দেন না। ওর সব টিফিন নিজ হাতে বাসায় তৈরি করে দেন।
দিনার বন্ধুরা এখন অনেকটাই সুস্থ। তাই দিনার মনটা বেশ ফুরফুরে। খাবার টেবিলে মাবাবার সাথে ওদের গল্পই করছে দিনা।
আইসক্রিমের কথা শুনতেই দিনার বাবা চমকে ওঠেন। দিনার দিকে তাকাতেই তার চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি। খাবার পুরোটা শেষ না করেই উঠে যান। দিনার আম্মু শেষ করতে বললেও শোনেননি। ব্যবসার ব্যস্ততা দেখিয়ে উঠে যান।
সারাদিন তিনি একটুও কাজে মনোনিবেশ করতে পারেননি। বারবার অসুস্থ শিশুদের ছবি তার চোখে ভাসছিল। একচোখে হাজার হাজার বাচ্চা, আর অন্য চোখে একমাত্র মেয়ে কলিজার টুকরো দিনা। নিজেকে বারবার অপরাধী মনে হচ্ছিল। আজ যদি তার নিজের মেয়েটাও এমন অসুস্থ হয়ে পড়ত?
রাতে বাসায় ফিরেও খাবার খাননি। কারো কথার কোনো উত্তরও দেননি। চুপচাপ দিনার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
দিনা মাকে জড়িয়ে মায়ের বুকে ঘুমাচ্ছে। দেখতে কত সুন্দর লাগছে! কী নিষ্পাপ, মায়াবী একটি মুখ! নিজের মেয়েকে ছুঁতে গিয়েও অপরাধবোধে ছুঁতে পারেননি। ধরতে গেলেই হাত কাঁপছে। নীরবে অশ্রু ঝরেই যাচ্ছে তার। শব্দও করতে পারছেন না। যদি মা, মেয়ের ঘুম ভেঙে যায়? তখন কী জবাব দেবেন? এসব ভেবে কেঁদে কেঁদে নিজেকে কিছুটা হালকা করলেন। তারপর সাহস করেই মেয়ের মাথায় হাত রেখে মেয়েকে কথা দিলেন। আর বিরবির করে বললেন- ‘মা রে আমাকে ক্ষমা করো, আমিই তোর বন্ধুদের অসুস্থতার জন্য দায়ী। আমাকে ক্ষমা করো মা।’
আজ তোকে কথা দিলাম মা- ‘এ ব্যবসায় আমি ছেড়ে দেবো। এমন অন্যায়ের ব্যবসা আমি আর করব না।’


আরো সংবাদ



premium cement