০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে গেছে হৃদয়

-


আমাদের ঘরের পেছনে যে খালটি ছিল, সেটি ছিল আধামরা। বর্ষায় মাত্র কয়েক মাস কর্দমাক্ত পানি থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই থাকত শুকনা। কালেভদ্রে যৎসামান্য জোয়ারের পানি এলেও সেটি ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। আমি এই একটি জিনিস ঠিকমতো এখনো বুঝি উঠতে পারিনি। দিনকে দিন নদীটি যত কাছে আসত খালটি ততটা শুকিয়ে যেত। এর আসল রহস্য সম্পর্কে যত কথা শুনেছি তার একটিও আমার মনঃপূত হয়নি। খাল নদীর এই নিদারুণ সম্পর্কের রহস্য এখনো আমার কাছে ঠিক ছোটবেলার মতোই অজ্ঞাত।
খালের পার আর আমাদের রান্নাঘরের মাঝখানের ঢালু জায়গাটির কথাও খুব মনে পড়ে। শীতের মৌসুমে মা সেখানে নানাবিধ সবজি চাষ করত। মাত্র কয়েক হাত জায়গা। তাতে পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, টমেটো, বেগুন থেকে শুরু করে কত রকম তরকারিরই না চাষ হতো। বেগুনগাছ লাগানোর একটি মজার ব্যাপার আছে। সাধারণত বেগুনগাছ শীতের সময় লাগানো হয়ে থাকে। যেদিন গাছ লাগানো হবে তার ঠিক পরের ১০-১৫ দিন পর্যন্ত তাকে ছায়া দিতে হবে।
তাই বেগুনগাছ ছায়া দেয়ার জন্য কলাগাছের ‘খোল’ কাটা হতো। তারপর ছোট লাঠি দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হতো পিচ্চি বেগুনগাছের মাথার ওপর দিয়ে। এরপর সন্ধ্যায় গিয়ে সব বেগুনগাছ হতে সেই কলাগাছের ‘খোল’ সরানো হতো। আবার কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে গিয়ে লাগিয়ে দেয়া হতো যথাস্থানে। এ কাজটি করতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। মক্তব হতে ফিরে এলেই ছুটে যেতাম এ কাজটি করার জন্য।


গ্রীষ্মকালে স্কুলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা ক্লাস হতো। তার পর ছুটি। মাঝখানে কোনো বিরতি নেই। ভোর সকালে মক্তবে যেতে হতো। সেখান থেকে এসেই ভাত খেয়ে সোজা স্কুলে। তাই অনেকটা ক্লান্ত হয়েই স্কুল থেকে ফিরতাম। বিল খাল শুকনা থাকলে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। তবে রাস্তা ঘুরে আসতে আরেকটু বেশি সময় লাগত। দু’টি সময় কিছু খাওয়া ছিল আমার অপরিহার্য রীতি। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে মক্তবে যাওয়ার সময়। দুই স্কুল থেকে ফিরে গোসলের আগে। সাধারণত এই দ্বিতীয় সময়ে পান্তা ভাত আর আধা রান্না হওয়া তরকারিই খাওয়া হতো। মাঝে মধ্যে অন্য কিছু।
আমাদের ঘরের সামনেই ছিল উঠোন। তার পর রাস্তা। আর অনেকটা রাস্তার উপরেই ছিল গরুঘর। এক সকালে মক্তব হতে এসে দেখি দাদাভাইয়ের অতি দুষ্ট গরুটির একটি বাচ্চা হয়েছে। মা, দাদু, ফুফুরাসহ আরো ক’জন মহিলা দাঁড়িয়ে দেখছে বাচ্চাটিকে। একদমই ওর মায়ের মতো রঙ। তবে বাচ্চাটি যেমনই ফুটফুটে তেমনি দুরন্ত। প্রথম প্রথম তো খুব শান্তই মনে হয়েছিল। পরে দেখা গেল সে দুষ্টের হদ্দ। তার গলায় ঘণ্টা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। দৌড় দিলেই সুন্দর শব্দ হতো। বাছুরটি যে রাস্তায় আর বিলে ছোটাছুটি করত সে রাস্তাটিও এখন আর নেই। নদীতে হারিয়ে গেছে সেও।
প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার শৈশব-কৈশোর খুব দামি, ভীষণ আনন্দের। ভালো লাগার ভালোবাসার। বুড়ো বয়সেও মানুষ নদীর কাছে ছুটে আসে। পুরনো স্মৃতি হাতড়ে সেসব জায়গায় সুখ খোঁজে সান্তনা খোঁজে। কিন্তু আমার তো আর কিছুই বাকি রইল না। আমি কার কাছে ফিরে যাব। কোথায় আমার শৈশবের সেই সোনালি দিনের খেলাঘর। বুকে কান্না চেপে রেখে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াই। হাত দিয়ে ইশারা করে বলি। ওই যে নৌকাটি দেখা যায় না। ওইখানে ছিল আমাদের বাড়ি।

 


আরো সংবাদ



premium cement