৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নেশার কাছে হেরে যাওয়া কুমার কাকার গল্প

চারাগল্প
-

বাজারসংলগ্ন একটি বাড়ি। মেইন রোডের পূর্বপাশ ঘেঁষেই কুমার বিশ্বাসের বাড়ি। একটা ছনের চাল আর ভাঙাচোরা পাটকাঠি দিয়ে বেড়া দেয়া। কুমার কাকা বড্ড রসিক মানুষ। কথা বলার ধরন, হাঁটাচলা, হাসি ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা রয়েছে সেটা হলোÑ কাশি। ভয়ানক এক কাশির শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। নাপিতের দোকানে বসে বসে খেয়াল করতাম কুমার কাকার দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া সব মানুষকেই ডেকে ডেকে বলতেন, ‘পান নেবেন নাকি! ভালো পান! কয় টাকা কম দিলেও হবে নে।’ কথা বলার স্ট্যাইলটাও ছিল মজার। কুমার কাকার বাড়ির পাশের কয়েকজন বন্ধু কুমার কাকার সাথে বেশ মজা করতেন। কুমার কাকাও বেশ মজার মানুষ। সঙ্গীতপ্রেমী কুমার কাকা গান করতে খুব ভালো বাসেন। চোখে মুখে যেন এক অসহায়ত্বের ছায়া বিরাজমান। পরে জানতে পারলাম কুমার কাকা তুখোড় নেশাগ্রস্ত। নেশা করতে না পারলে মাথা ঠিক থাকে না। শান্ত কাকার বাড়ি কুমার কাকার বাড়ির পাশেই। চায়ের দোকানদার গোপালের বাড়িও আশপাশে। দু’জনেই বলাবলি করতে লাগল, নেশার বিগের উঠেছে। পান বিক্রি করেই নেশা করবে। অদ্ভুদ সব কথাবার্তা। কখনো বলছেÑ এই বাড়ি থেকে সবাই নেমে যাও। আমি এখন ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবো। আবার একই মুখে বলছে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গাঙ্গের থেকে এই কলসে করে পানি এনে সেই আগুন নিভাব। এই বলে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কলস হাতে নিয়ে সেটাকে ঘরের পুতার সাথে কয় বাড়ি দিয়ে ভেঙে ফেললেন। এরপর একা একা বিচ্ছিরি গালিগালাজ করছেন। আমি ওখান থেকে এসে শান্ত কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, কুমার পাগলার বাড়িতে কি আর কেউই নাই? বউ, ছেলে-মেয়ে? শান্ত কাকা জানালেন, বউ আছে আর একটা ছেলে। আমি বললাম, কিন্তু কেউই তো কোনো কথা বলছে না। একা একাই বকছে। শান্ত কাকা বললেন, ও ওদের অভ্যাস হয়ে গেছে। ওদের এক কায়দায় মুখস্থ হয়ে গেছে যে, কখন কী করবে। আর জানে, একটু পরে এমনিতেই থেমে যাবে। কিছু বললে হয়তো আরো বাজবে। তাই তো চুপ করে থাকে। এর আগে দুই-তিনবার ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গোপাল পাশের চায়ের দোকান থেকে হেসে হেসে বললÑ ওগুলো নেশার গেঁরো। বুঝেছ ভাইপো। আমি মাথা নাড়ালাম। এরপরের দিনগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে কুমার কাকাকে ফলো করতে লাগলাম। দেখলাম কুমার কাকাকে নিয়ে অনেক ছোট ছোট মানুষও মজা করে। বিশেষ করে স্ট্যান্ডের বেশির ভাগ গাড়ির স্টাফরা। কুমার কাকাকে সামান্য নেশার লোভ দেখিয়ে একের পর এক গান গাওয়ান। কখনো কুমার কাকার এটা ওটা সেরে রেখে কুমার কাকাকে হেনস্থা করতেন। কখনো কখনো কুমার কাকার লুঙ্গি ধরেও টানাটানি করতেন। নেশাখোর হোক আর পাগলÑ যাই হোক না কেন, মানুষ তো। বাবার বয়সী মানুষ। সেই মানুষগুলোর সাথে এমন আচরণ সত্যিই আমাকে খুব হতাশ করত। একদিন কুমার কাকা শান্ত কাকার দোকানে এসে দুই টাকার বিড়ি আর এক টাকার একটা ম্যাচ কিনে পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়েছিলেন। দুই টাকা ফেরত নিয়ে যখনই হাঁটা শুরু করলেন তখনই গাড়ির এক স্টাফ খপ করে কুমার কাকার লুঙ্গি ধরে টান দিলেন। লুঙ্গি খোলার উপক্রম হলো। কুমার কাকা তাকে দাবাড় দিতেই লুঙ্গিটা একদম খুলে গেল। কুমার কাকার পছন্দের গান, যে গানটা বেশির ভাগ সময়ই গাইতেন সেটা হলো ‘আমি বন্দী কারাগারে’। সেদিন বাজারে গিয়ে অনেক দিন পর কুমার কাকাকে দেখলাম। গোপালের চায়ের দোকানে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছেন। আমি গিয়ে পাশে বসতেই মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভালো আছ?’ আমি বললাম, ‘আছি।’ আপনি কেমন আছেন শুনতেই একটা অন্যরকম অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, ‘ভালো না।’ আমি খেয়াল করে দেখলাম কুমার কাকার হাত-পা শুকিয়ে একদম কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। চোখ দুটো অনেক গভীরে ঢুকে গেছে । মাথা কাঁপা রোগটাও বেশ এঁটেগুটেই ধরেছে। এরপর আমি বললাম, ‘কাকা আমার একটা গান গেয়ে দেয়ার কথা ছিল আপনার, কবে গাইবেন।’ কুমার কাকা বললেন, ‘এখন আর হাফ নাই। নিঃশ্বাস ছাড়তেই কষ্ট হয়। কথা শেষে কুমার কাকা লাঠি ভর দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। অনেক দিন দেখি না। সেদিন হঠাৎ মনে পড়ল কুমার কাকার কথা। বাজারের দোকানদার শান্ত কাকাকে ফোন করে শুনলাম কুমার কাকা মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। অবশেষে নেশার কাছে পরাজয় শিকার করে ইহলোক ত্যাগ করলেন কুমার কাকা।


আরো সংবাদ



premium cement