০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বৃষ্টিভেজা রাতে

চারাগল্প
-

সন্ধ্যা নেমেছে খানিক আগে। শ্রাবণের আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। হয়তো প্রচুর বৃষ্টি নামবে আজ। আকাশ ঝরাবে বিরহ অশ্রু। মুছে দেবে সব দুঃখ বেদনা।
নাহিন মিরপুর-১-এর সরু একটা গলি দিয়ে আনমনে হাঁটছে। গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি। চোখে মোটা চশমা। কাঁধে ঝুলছে পুরনো ব্যাগ। তাতে কবিতার বই আর হাবিজাবি সব কাগজপত্র রাখা। সময় পেলেই কবিতা লিখতে বসে পড়ে। ভাবনাগুলো নিংড়ে দেয় কাগজে। নির্জন পথে কবিতা আওড়ে এগোচ্ছে সে। বেশ ভালোই লাগছে। ঢাকা শহর আগের মতো এখন আর নির্জন নয়। সবখানে কোলাহল। নির্জন জায়গা না হলে কবিতা আসে না। তাই একটু ফুরসত পেলে নাহিন বেরিয়ে পড়ে নির্জনতার খোঁজে। এ সময় নামল ঝুম বৃষ্টি। সেই সাথে ঝড়ো বাতাস। নাহিন দৌড়ে একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল। ফ্ল্যাটের নিচতলার রুমের দরোজা খোলা। ভেতরটা অন্ধকার। হয়তো ইলেকট্রিসিটি নেই। করিডোরে দাঁড়িয়েও বাতাসের ঝাপটায় নাহিন ভিজে যাচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে অপরিচিত ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়তে পারছে না। এ সময় দরোজার আড়াল থেকে একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, ‘এখানে দাঁড়িয়ে তো ভিজে যাচ্ছেন। ভেতরে এসে বসুন।’
নাহিন বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে কোনো কিছু চিন্তা না করেই দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ল। বাইরের আবছা আলোয় ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নারীমূর্তির চেহারা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। কেবল অবয়ব দেখা যাচ্ছে। নারীমূর্তি নাহিনকে সোফায় ইশারা করে বসতে বলল। নাহিন বসলে নারীমূর্তিও তার থেকে একটু দূরে বসল। নাহিন জিজ্ঞেস করল, ‘বাসায় আর কেউ নেই?’
একরকম হতাশ গলায় নারীটি বলল, ‘আমি একাই থাকি। কিছু মনে করবেন না, ঘরে মোমবাতি বা লাইট নেই। কিছুক্ষণ আপনাকে অন্ধকারেই বসে থাকতে হবে।’
নাহিন ভদ্রতা দেখিয়ে যদিও বলল, ‘আচ্ছা, সমস্যা নেই’, কিন্তু এমন বৃষ্টির রাতে অন্ধকার কক্ষে একটা নারীর সামনে বসে থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করল না। এরপর দু’জনই চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিস্তব্ধতায় এগোতে থাকল সময়ের প্রহর। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। দু’জন দু’জনার পরিচিত মুখ দেখে চমকে উঠল। বিস্ময়ে নাহিন হালকা আর্তনাদের মতো করে বলল, ‘অর্পা তুমি!’
অর্পা নাহিনকে দেখে এতটাই ধাক্কা খেয়েছে যে, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল নাহিনের দিকে। ঠোঁট কাঁপছে তার। চোখ টলমল করছে জলে। হয়তো এখনই গড়িয়ে পড়বে শ্রাবণধারা।
নাহিন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তখন থেকেই কবিতাচর্চা করত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশও হতো। সবার থেকে আলাদা হয়ে কবিতার পেছনেই কাটাত সময়। অর্পা নাহিনদের ক্লাসেই পড়ত। রূপে-গুণে সে ছিল অনন্যা। নাহিনের কাব্যপ্রেম দেখে সেও নাহিনের প্রেমে পড়ে যায়। অর্পা নিজেই নাহিনকে প্রস্তাব দেয়। রূপবতী একটা মেয়ের প্রস্তাব নাহিন অগ্রাহ্য করতে পারেনি। গ্রহণ করে নেয় অপকটে। ভালোবাসার দোলনায় দুলতে থাকে দুজন। এগোতে থাকে তাদের সুখের দিনগুলো। নাহিন অর্পাকে সামনে বসিয়ে প্রতিদিন একটা করে কবিতা আবৃতি করে শোনাত। শুনে অর্পা কেবল হাসত। তার কাচভাঙা দাঁতের সেই হাসি মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখত নাহিন। ভাবত, এই সুখগুলো কোথায় লুকিয়ে ছিল এত দিন!
কিন্তু নাহিনের এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। অর্পা তাকে ধোঁকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধনী ক্যাডারের সাথে পালিয়ে গেল। এতটা ভালোবাসার পর অর্পা ওকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ হাজারো চিন্তা করে নাহিন বুঝতে পারল না। অনেক দিন পর নাহিন কবিতার বইয়ের ভাঁজে অর্পার একটা চিরকুট পায়। তাতে লেখা, ‘আমি ভেবে দেখলাম, তোমাকে বিয়ে করলে কোনো দিন সুখ পাবো না। তোমার তো কোনো অর্থসম্পদ নেই। কবিতা বিক্রি করে খাওয়াবে আমায়? তাই তোমাকে ছেড়ে গেলাম। পারলে ক্ষমা করে দিও।’ Ñঅর্পা
নাহিন অনেক চেষ্টা করল অর্পাকে ভুলে থাকতে। কিন্তু পারল না। ক্ষণে ক্ষণে অর্পার স্মৃতিগুলো নাহিনকে দিত পাহাড়সম যাতনা। হাজারো কষ্ট বুকে ধরে একাকী পার করে দিলো আটটি বর্ষা। এত দিন পর অর্পার সাথে এমন আকস্মিক দেখা হবে, কোনো দিনও ভাবেনি নাহিন।
অর্পা মাথা নিচু করে কাঁদছে। এত বড় অপরাধীকে সামনে পেয়েও নাহিন কোনো রাগ দেখাল না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন চলছে তোমাদের বৈবাহিক জীবন?’
অর্পা আহত গলায় বলল, ‘যে ছেলের সাথে পালিয়ে এসেছিলাম, তাকে প্রথমে খুব ভালো মনে হয়েছিল। কিন্তু এক মাস সংসার করার পর কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, আর ফিরে এলো না। অনেক খুঁজেছি তাকে, পাইনি। বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে করায় সেখানেও উঠতে পারিনি বাবার ভয়ে। একটা এনজিওতে কোনোমতো চাকরি জুটিয়ে একাকী দিন পার করছি। তোমার অবস্থা বলো। স্ত্রী-সংসার নিয়ে কেমন আছো?’
নাহিন বলল, ‘আমি এখনো বিয়ে করিনি। একবার কাউকে ভালোবাসার পর সে ভালোবাসায় অন্যকে ভাগ দেয়া যায় না।’
খুশিতে ঝলমল করে উঠল অর্পার দুটো চোখ। নাহিনের ডান হাতটা চেপে ধরে আপ্লুত গলায় বলল, ‘পুরনো কথা ভুলে চলো না আবার আমরা নতুন করে আমাদের জীবন গড়ি!’
এক ঝটকায় নাহিন হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে। রাগে-ক্ষোভে পুরো শরীর কাঁপছে তার। চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আরো দুঃখ দিতে আমার জীবনে ফের কেন আসতে চাও?’
সাভার, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement