১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`
সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নারী কর্মী সুমি ফিরল বাবা-মায়ের কাছে

‘প্রতি রাতেই আমার শরীরের ওপর চলত নির্যাতন’

‘প্রতি রাতেই আমার শরীরের ওপর চলত নির্যাতন’ - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রতি রাতেই আমার শরীরের ওপর চলত নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই করা হত মারধর। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতে তারা থেমে যেত না। ওই অবস্থায়ই শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা। কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো-প্রশ্ন করেন সুমি। হ

ঠাৎ একদিন আমাকে জোর করে অন্য একটি বাসায় পাঠানো হলো। নতুন বাসায় গিয়ে আমি পড়লাম আরেক বিপদে। সেখানে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করত। নতুন মালিক (কফিল) বলত, বাংলাদেশি প্রায় চার লাখ টাকায় তার কাছে আমাকে বিক্রি করেছে। ওই মালিক বলেন, তোকে কিনে এনেছি। তোর সাথে যা ইচ্ছা তাই করব। এভাবে প্রতি রাতে আমার ওপর যৌন নির্যাতন করা হতো। এভাবেই নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়ি ফেরা নারী কর্মী সুমি আক্তার।

শুক্রবার বিকেলে প্রশাসনের মাধ্যমে সুমি আক্তারকে তার বাবা-মার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় প্রবাসী কল্যাণ ডেক্সের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসান, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর প্রধান, তার বাবা-মা, স্বামীসহ আত্মীয় স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। সুমির বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতী সেনপাড়া গ্রামে। সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম পেশায় একজন দিনমজুর। চার-ভাই বোনের মধ্যে সুমি বড়। এর আগে সকাল সোয়া ৭টায় এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সুমি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।

সুমির পরিবারের সদস্যরা জানান, চলতি বছরের ৩০ মে রিক্রুটিং এজেন্সি ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’র মাধ্যমে সৌদি আরব যান আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের স্ত্রী সুমি। সেখানে যাওয়ার পর নিয়োগকর্তা (কফিল) ও অন্যদের পাশবিক নির্যাতনের মুখে পড়েন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এ মাসের শুরুর দিকে এক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিওবার্তায় কান্নায় ভেঙে পড়ে দেশে ফেরার আকুতি জানান সৌদ প্রবাসী সুমি।

ওই ভিডিওতে সুমি বলেন, ‘ওরা আমারে মাইরা ফালাইবো, আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়া যান। আর কিছু দিন থাকলে আমি মরে যাবো। ভালো কাজের’ কথা বলে এনে এখন তারা ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে।’

এরপর জেদ্দা কনস্যুলেটের হস্তক্ষেপে (৪ঠা নভেম্বর) সুমিকে নিয়োগকর্তার (কফিল) বাড়ি থেকে পুলিশ নিয়ে এসে তাকে সেইফ হোমে রাখে। কিন্তু ৫ই নভেম্বর পাওনা ২২ হাজার রিয়াল পাওয়ার আগে তাকে ‘ফাইনাল এক্সিট’ দেবেন না বলে জানিয়েছিলেন কফিল। সৌদি আরবের নাজরান শহরের শ্রম আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তির পর সুমির দেশে আসার পথ তৈরি হয়। ১০ই নভেম্বর আদালত সুমির কফিলের (নিয়োগকর্তা) দাবি করা ২২ হাজার সৌদি রিয়াল পরিশোধের আবেদন নামঞ্জুর করে এবং সুমিকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দেশে ফেরা হল সুমির।

জানা গেছে, দুই বছর আগে আশুলিয়ার চারাবাগের নূরুল ইসলামের সাথে বিয়ে হয় সুমির। বিয়ের পর সুমি জানতে পারেন, আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সতীনের সাথে সংসার শুরু করেন। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তানও হয়। কিন্তু সতীনের বিভিন্ন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ও সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্নে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুমি। এ উদ্দেশ্যেই চলতি বছরের জানুয়ারিতে গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ শেষ করেন। তাকে বিনামূল্যে সৌদি পাঠানোর লোভ দেখায় দালালেরা। শেষমেশ মে মাসে সৌদিতে পাড়ি জমান নিম্নবিত্ত ঘরের এ গৃহবধূ। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর কথা বলে দালালচক্র যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে সে কথা জানতেন না সুমি। সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় মারধর, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন নির্যাতন। মেয়ের নির্যাতনের কথা শুনতে পেয়ে চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটান মা মলিকা বেগম।

মলিকা বেগম জানান, আমরা মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে এনে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, অভাব অনটনের সংসারে কিছু টাকা কামানোর জন্য বিদেশে গিয়েছিল মেয়েটা (সুমি)। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন অবস্থার শিকার হবে আমার এই মেয়ে।

সুমির স্বামী নূরুল ইসলাম জানান, সৌদি আরবে যাওয়ার পর সুমিকে এক বাড়িতে গৃহকর্মীর চাকরি দেয়া হয়। তবে বাড়ির মালিক তাকে ঠিক মতো খেতে দিত না। বিভিন্ন সময় শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো। দেশে পরিবারের সাথেও তাকে কথা বলতে দেয়া হতো না। নির্যাতনের শিকার সুমি বর্তমানে ঠিক মতো দেখতে পান না। তার হাতে গরম পানি ঢেলে নির্যাতন করা হয়েছে। এসব ঘটনা শোনার পর সুমিকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য তার স্বামী বাদী হয়ে তাকে সৌদিতে পাঠানো  রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠান ‘রূপসী বাংলা এজেন্সি’র মালিক আক্তার হোসেনের নামে পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে আমাদের এখানে তাকে পাঠানো হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামালের উপস্থিতিতে বাবা মায়ের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement