২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তাদের দিয়ে ঠিকাদারি

-

গত ১৫ জুলাই কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকার পাতায় ‘মাস্তান বাহিনী দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ থাকায় এলজিইডি ভবনে আয়োজিত এক সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনারা (প্রকৌশলীরা), রাজনৈতিক নেতারা মিলে মাস্তান বাহিনী বানিয়ে ফেলেছেন। ওদের দিয়ে কাজ করান। পেশাদার ঠিকাদার পাওয়া যায় না। এ দুর্ভাগ্য নিজেরাই ডেকে এনেছি। কেউ দায়িত্ব নিতে চান না। ফলে এই গণ্ডগোল হচ্ছে।’
গত ১০ বছরে যদি অন্য দলের সরকার ক্ষমতায় থাকত তাহলে ধরে নেয়া যেত মন্ত্রী মহোদয় সাবেক সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি যুৎসই এক তীর ছুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু যেহেতু গত ১০ বছর একই দলের সরকার ক্ষমতায় আছে, তাই পেশাদার ঠিকাদার তৈরি না হওয়ার দায় বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ওপরই বর্তায়। মন্ত্রী নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, ২০০৯ সালে তার দল ক্ষমতাসীন হয়েই দলীয় লোকদের মধ্য থেকে ঠিকাদার সৃষ্টির লক্ষ্যে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত কাজের ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্ত থেকে, অভিজ্ঞতার আগের শর্ত বাদ দেয়ার কারণেই ‘মাস্তান বাহিনীর ঠিকাদার’ সৃষ্টি হয়েছে। পেশাদার ঠিকাদাররা ই-মেইলের মাধ্যমে দরপত্র দাখিল করে দলীয় স্থানীয় ক্যাডারদের এড়িয়ে কাজ পেলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন তো ই-মেইলের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। কারণ, প্রকল্প স্থলে প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী ও শ্রমিক পাঠাতে হয়। তাই তাদের স্থানীয় নেতাকর্মীদের ‘চাঁদা’ দিতে হয়। ফলে কাজের মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না বলে পেশাদার ঠিকাদাররা দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য। প্রকৌশলীদের অনেকে আরো এক কাঠি সরেস। তারা বলে থাকেন, আমরা প্রকল্প ব্যয়ের প্রাক্কলন করার সময় অনুমিত ব্যয় ২০-২৫ শতাংশ বেশি দেখিয়ে প্রকল্প পাস করে এনেছি। কাজেই ‘তাদের’কে টাকা দিলে ঠিকাদারদের লাভের অংশ কম পড়বে না। ফলে দলীয় লোক হিসেবে নি¤œমানের কাজ করে লাভের অঙ্ক স্ফীত করলেও প্রকৌশলীরা নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হন। এই দুর্নীতির ভাগীদার তাদেরও অনেকে। সৎ যে প্রকৌশলীরা আছেন, তারা কাজের মান নিয়ে আপত্তি করলে মাস্তান বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার শঙ্কায় ভুগতে হয়।
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিতাড়িত হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরও আইয়ুবী প্রেতাত্মা আজো আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আছে। তার বিডি সিস্টেমেই আমরা জেলা পরিষদ গঠন করেছি। অর্থবছরে প্রথম ৯-১০ মাস হাত গুটিয়ে বসে থেকে এপ্রিল-জুন মাসে বৃষ্টি শুরু হলে প্রকল্পের টাকা ছাড় করার ধুম পড়ে যায়। গত অর্থবছরের মে-জুন মাসে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৩২৫ কোটি টাকা ‘খরচ’ করা হয়েছে। কাজ না করেই ৩০ জুনে বরাদ্দের সব টাকা ‘খরচ’ দেখিয়ে চেক ইস্যু করা হয়। পরে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করে জুলাই-আগস্ট মাসে একই ঠিকাদারদের চেক হস্তান্তর করতে দেখা যায়।
২০১৪ সালে ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনের পর ইউপি থেকে জেলা পরিষদ এবং পৌর ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করায় এবং ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শতভাগ ভোট কাটার নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ পর্যন্ত সব স্তরে ক্ষমতাসীন দলের জয় হয়েছে। তাই স্থানীয় সরকারের সব প্রকল্পের টাকা ছাড়ের পত্র তড়িঘড়ি করে জুন মাসের ১৫ তারিখে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বরাবরে প্রেরণ করায় এক দিনের মধ্যে প্রতি উপজেলায় শত শত দরপত্র বিক্রি হয়েছে। তবে দাখিল করা হয় হাতেগোনা তিন-চারটি করে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বেঁকে বসায় বহু উপজেলায় তার সাথে উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার কারণে জেলা প্রশাসকদের ‘মধ্যস্থতা’ করতে হচ্ছে। আগের টার্মের মনোনীত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সময় প্রায় ৪০ শতাংশ প্রকল্পের কোনো হদিস না পাওয়া গেলেও ওইসব প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের চেক চেয়ারম্যান সাহেবের পিএ’র নামে ইস্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের সাথে প্রশাসনিক কর্মকর্তার হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। গত ১০ বছরে কথিত বাহিনীর ঠিকাদারের সংখ্যা ত্বরিত বৃদ্ধি পাওয়ায় একেকটি কাজে শত শত দরপত্র বিক্রি হচ্ছে। ‘পরিচর্যা’র মাধ্যমে যে টেন্ডারবাজ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে, এখন তা বুমেরাং হয়ে উঠেছে। জেনারেল মইনের সাহায্যে ‘১/১১’ ঘটিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার সুবাদে, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের সহায়তায় এই বিশেষ বাহিনী মধ্যরাতে শতভাগ ভোট কেটে একই দলকে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন করেছে। পুরনো মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে নতুনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ায় গত ১০ বছরে সংঘটিত অনিয়মগুলো চেপে রাখতে মন্ত্রীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবুও দু-চারজন মন্ত্রীর মুখ ফসকে সত্য নির্গত হওয়ায় সাবেক মন্ত্রীরা হচ্ছেন নাখোশ। যেমনÑ স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর মুখ দিয়ে মাস্তান বাহিনীর ঠিকাদার তৈরি হওয়ার খবর বের হয়েছে। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দেয়ার জন্য সাবেক শিল্পমন্ত্রীকে মুখ রক্ষার্থে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবন নির্মাণে এবং আসবাবপত্র ক্রয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজে ৪৫ কোটি টাকা দুর্নীতির বালিশ উপাখ্যানের ব্যাপারে গণপূর্তমন্ত্রী কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন। তার জবাব প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে সব দায় ‘সাবেক ছাত্রদল নেতা’র ওপর চাপালেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করেছেন। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় (চারলেন সড়ক দ্বিগুণ ব্যয়ে নির্মাণ করেও তাতে খানাখন্দ সৃষ্টির দায় অতিবৃষ্টির ওপর চাপিয়েছে। অথচ বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য গরিব এ দেশে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যেসব মন্ত্রণালয়ে আগের মন্ত্রীরাই রয়ে গেছেন, তারা কৌশলী বক্তব্য রাখছেন। যেমনÑ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আগের চেয়ে আরো ভালো হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন করে দেয়ায় জনগণ ন্যায়বিচার পাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যিনি আগে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সবিশেষ লক্ষণীয়। শিক্ষামন্ত্রী মাত্র ছয় মাসে পাসের হার ৬৩ থেকে ৭১ শতাংশে উন্নীত করেছেন। মন্ত্রীর নিজ বৃহত্তর জেলা কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের কর্মচারীরা এবং শিক্ষকেরা পরীক্ষার্থীদের এমন সাজেশন দিয়েছিলেন যে, এক লাফেই ইংরেজিতে পাসের হার ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। ওই বোর্ডের সার্বিক পাসের হার ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭.৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তথ্যমন্ত্রী তার পূর্বসূরির অনুসরণ করে মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বিএনপির প্রতি কুনজর দেন বেশি। খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য পূর্বসূরির সময় কেনা নি¤œমানের ধান-চালে গুদামভর্তি থাকার বিষয়টি চেপে গিয়ে গুদামভর্তি থাকার অজুহাতে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় সীমিত করে দিয়েছেন। মন্ত্রী বাম্পার ফলনকেই ধানের মূল্য হ্রাসের কারণ বলে জানিয়েছেন। নদী খননে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঁচ বছরের অনিয়ম চেপে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রীকে।
একটানা দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার সুফল ও কুফল উভয়ই আছে। বর্তমানে প্রধানত কুফলের পরিণাম ভোগ ও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ‘বিএনপি সরকার সব কিছু শেষ করে দিয়ে গেছে’ এ ভাঙা রেকর্ড পাঁচ বছর বাজানোর পর ২০১৪ সালে ‘উন্নয়নের অগ্রগতি ধরে রাখা’র ধুয়া তুলে ভোটের অধিকার ৫১ শতাংশ কার্টেল করে, ভোটারবিহীন নির্বাচন করা হলো। এভাবে ১০ বছর পার করে ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ‘শতভাগ’ ভোট কাটার নির্বাচনের বদৌলতে সরকার গঠনের পর নবনিযুক্ত ব্যক্তিরা মন্ত্রণালয় চালাতে গিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছেন। না পারছেন মুখফুটে সত্য প্রকাশ করতে, না পারছেন হজম করতে। তবুও কুচ পরোয়া নেইÑ কারণ আগামী নির্বাচনকালে তারাই ক্ষমতায় থাকবেন বলে সম্ভবত তাদের জয় অনিবার্য। জনগণের ভোটাধিকার হারা হওয়াও উন্নয়নের গতির মতো অব্যাহত থাকবে বলে সাধারণ মানুষের ভাগ্য যে তিমিরে আছে, সেই তিমিরেই হয়তো থেকে যাবে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? হ


আরো সংবাদ



premium cement