২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ ও বাংলাদেশ

চোখের আলোয়
-


বিশ্বে এই মুহূর্তে একটি বড় ধরনের যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধে ট্যাংক কামানের গোলাগুলি নেই, বিমানে বিমানে ডগফাইট নেই, বোমা ফেলা বা মানুষ হত্যা নেই, কান্না-হাহাকার, ধ্বংসের বীভৎসতা নেই। এটি হলো এক নীরব যুদ্ধ। তা চলছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র-বিশ্বের দুই প্রধান অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে। রণক্ষেত্র হলো বাণিজ্য খাত। এ যুদ্ধের মেয়াদ এক বছরের বেশি হয়ে গেল এরই মধ্যে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছেন না। জয়-পরাজয় চিহ্নিত করার মতো অবস্থায় আজো কেউ পৌঁছেননি।
দুই পরাশক্তির এই দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যযুদ্ধ বর্তমান বিশ্বরাজনীতির অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ যুদ্ধের সূচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি অনেক দিন ধরেই চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যক্ষেত্রে ‘অনৈতিক সুবিধা নেয়া এবং মেধাসম্পদ চুরির’ অভিযোগ করছিলেন। সেই অভিযোগ খুব অনিবার্যভাবে অস্বীকার করে এসেছে চীন। একপর্যায়ে ট্রাম্প অনেকটা যেন অধৈর্য হয়েই চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেন। প্রথমে চীন থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানিতে ১৫ শতাংশ শুল্ক বসান। দ্বিতীয় দফায় মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য মার্কিন শুল্কের আওতায় আসে। শুল্কের পরিমাণ বেড়ে হয়ে যায় ২৫ শতাংশ। মূলত মেধাস্বত্ব অধিকার, শিল্প খাতে ভর্তুকি, বাজারে প্রবেশের সুবিধাÑ এসব নীতি পরিবর্তনের জন্য চাপ দিতেই এই শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।
গত ১০ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন থেকে আরো প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেন। কার্যত ট্রাম্পের এটা গায়ের জোরে চাপিয়ে দেয়া একতরফা ব্যবস্থা। চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ছয় হাজার কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, বিরোধ এড়াতে দুই দেশের মধ্যে চলতি বছরের মাঝামাঝি যেসব আলোচনা হয়েছে সেই আলোচনাও মূলত ব্যর্থ হয়ে গেছে। আলোচনা ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ট্রাম্পই।
চীন বলছে, ‘অন্যায্য’ বাণিজ্যের কথা বলে যে বিরোধ ট্রাম্প শুরু করেছেন সেটা ক্রমেই ভূ-রাজনৈতিক শক্তির লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। চীনের গণমাধ্যমের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘এই বিরোধ কেবল বাণিজ্য নিয়ে নয়, এটা হলো প্রযুক্তি নিয়ে, চিন্তার অবাধ প্রবাহ নিয়ে, আর ব্যক্তিবিশেষের অবাধ চলাচল নিয়েও বিরোধ দেখা দিতে যাচ্ছে। সুতরাং এটি সত্যিকার অর্থেই একটি বৃহত্তর লড়াই, এ লড়াই এমনিতে থেমে যাবে না।’
দুই পরাশক্তির বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব কেবল দুই দেশের অর্থনীতির ওপরই পড়ছে না। বরং গোটা বিশ্বেই এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। বছরের পর বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুবাদে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা ১৯৯০ সালের পর সর্বনি¤œ। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতির আওতায় রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে একটি বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন, যার উদ্দেশ্য বিশ্বের অর্থনীতিতে চীনের এক নম্বর হয়ে ওঠা। এর প্রধান উপাদান হবে রোবোটিক্স এবং ইলেকট্রিক ভেহিকেলসের মতো প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া।
বিশেষ করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের গায়ে জ্বালা ধরাবে না, এমন মনে হয় না। তখন বাণিজ্যযুদ্ধ সত্যিকারের শক্তির লড়াই হয়ে উঠতে পারে। যা হোক, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের চলমান দীর্ঘমেয়াদি বিরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বে। প্রভাব পড়ছে এশিয়ায়। বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা আবারো বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করছেন। দেশে দেশে কর্মসংস্থান আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। আর্থিক বাজারে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো, এশিয়ার তুলনামূলকভাবে ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বেশ ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বড় অর্থনীতিগুলোরও গতি মন্থর হয়ে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ বাণিজ্যযুদ্ধ অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এই আশঙ্কার কারণ হলো, শুল্কমুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপন্ন হচ্ছে, শুল্ক আরোপের ফলে উৎপাদন তার চেয়ে কমে যাবে। অর্থাৎ শুল্ক আরোপের ফলে কিছু উৎপাদক, যারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্যে অর্থনৈতিকভাবে বাজারে টিকে থাকতে সক্ষম, তারা আর টিকে থাকতে পারবেন না। ফলে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্ব বাড়বে। অন্য দিকে, ভোক্তারা সেই পণ্য বা সেবা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হবেন।
এসব কারণেই বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি মন্দার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা। আশঙ্কার মূল কারণ চীন-মার্কিন চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ। বলা হচ্ছে, দেশ দুটি একে অপরের পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর করে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই যুদ্ধ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পর্যায়ক্রমে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি চীনের কাঁচামালে তৈরি করা পণ্য রফতানিতেও আমেরিকা বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতে পারেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে যেতে পারেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে, তার পরও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। চীনের অভিযোগ, বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।’ এ অভিযোগ অসত্য নয়।
আমাদের দেশের সম্ভাবনা
চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ। যেমন ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া। চীনে তৈরী পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা বাড়তি শুল্ক এড়াতে দেশটি থেকে আমদানি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকবে নিশ্চয়ই। ফলে চীনের হারানো বাজার ধরার সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশ ও উল্লিখিত দেশগুলোতে।
সহযোগী ডেইলি স্টারের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চীন থেকে ১২ শতাংশ কম পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে, ভিয়েতনাম থেকে আমদানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ, বাংলাদেশ থেকে ১৪ শতাংশ, তাইওয়ান থেকে ২৩ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১২ শতাংশ।
আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ফলে বেসবল ক্যাপ, ব্যাগ, মোটরসাইকেলের মতো চীনা পণ্য আমেরিকানদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্য, যেমনÑ ওয়াশিংমেশিন, ডিশ ওয়াশার, হেয়ার ড্রায়ার, ওয়াটার ফিল্টার ইত্যাদির ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বাড়তি শুল্ক।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণার পর মে মাসে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের এক জরিপে দেখা যায়, বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ কোম্পানি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নেয়ার কথা বিবেচনা করছে। আর ইতোমধ্যে যারা চীন ছেড়েছে তাদের এক-চতুর্থাংশই পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গেছেন। মাত্র ছয় শতাংশ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা সরিয়ে নিয়ে গেছে।
মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর চীন ছাড়ার প্রবণতা অবশ্য শুল্ক আরোপের আগেই শুরু হয়েছিল। কারণ চীনের সস্তা শ্রমের সুবিধা নিতেই তারা সে দেশে কারখানা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে শ্রমবাজার আর সস্তা নেই। বরং চীনের চেয়ে অনেক কম খরচে পাশের দেশগুলো থেকে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ কারণেই ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরী পোশাক রফতানি ক্রমেই বাড়ছে। তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রনিক্স বাজারের চাহিদা পূরণ করছে।
বাংলাদেশ যদি এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, তাহলে আমাদের জন্য উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমাদের সরকারগুলোর এক ধরনের দুর্বলতা সব সময়ই থাকে। তারা সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রায়ই ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে, ভিয়েতনামের চেয়ে আমরা নতুন ক্রেতা ধরার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছি। কিন্তু সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা এড়াতে আমাদের পিছিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের এখনই সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement