২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার

-

গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ড। সেখানকার ইংরেজেরা এই উপমহাদেশে আমাদের প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছেন। তাদের কাছ থেকে ধার করে আনা গণতন্ত্র কতটুকু প্রস্ফুটিত হলো? ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়া বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান), পাকিস্তান (পশ্চিম পাকিস্তান) ও ভারত একই সাথে স্বাধীনতা অর্জন করলেও এই দেশগুলোতে গণতন্ত্রের বিকাশে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যেখানে বেশির ভাগ সময় সামরিক শাসন বজায় ছিল, সেখানে ভারতে কখনো সামরিক শাসন জারি হয়নি, ফলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। কেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ঘন ঘন সামরিক শাসন জারি হলো; এর একমাত্র কারণ পাকিস্তানি তৎকালীন নেতৃবৃন্দের দুর্বল নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার অভাব। তা ছাড়া, পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ সেনাবাহিনীকে অন্যায় ও অন্যায্য কাজে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের প্রতি তাদের বর্বরতা ও ১৯৭১ সালে নিষ্ঠুর নির্মমতার জেরে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হলেও সেনাবাহিনীর প্রতি ভীতি কাটতে কিছুটা সময় লেগেছে। এই সুযোগে দুই দেশের সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থে, সুবিধা মতো দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। অন্য দিকে ভারতের নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতা ও সেনাবাহিনীকে অন্যায্য কাজে ব্যবহার না করায় তাদের শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কখনই ছিল না এবং সাধারণ মানুষেরও এই বাহিনীর প্রতি কোনো ভীতি ছিল না। বর্তমান বাংলাদেশ এই ভীতি কাটিয়ে উঠেছে, তবে গণতন্ত্রের বিকাশ পরিপূর্ণতা পায়নি এখনো। তাই এ ক্ষেত্রে যারা রাষ্ট্রীয় অভিভাবক, তারা কিছু ব্যাপার বিবেচনায় নিতে পারে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রাপ্ত বয়স্কদের সবার অংশগ্রহণ বা গণ-অংশগ্রহণ থাকে, তবে গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বে সুশাসন বজায় থাকায় সেখানে নির্বাচনপূর্ব বা নির্বাচনোত্তর সংঘর্ষ, গণগ্রেফতার বা অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক কাজ চোখে পড়ে না। আমাদের সেই পর্যায়ের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যক্ষ গণ-অংশগ্রহণ করলে ভালো হয়। বর্তমানে জাতীয় নির্বাচনে পরোক্ষ অংশগ্রহণ করা যায় কি না তা বিবেচনা করা উচিত, সে ক্ষেত্রে গণগ্রেফতার বা গণসংঘর্ষ অনেকাংশে কমবে। তা ছাড়া, ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের কারণে ব্যাপক শত্রুতার সৃষ্টি হয়। এবার আমাদের নির্বাচনে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি ভোটে অংশগ্রহণ করে এতে যে পরিমাণ মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, ঠিক এ সংখ্যাটি যদি ১০ লাখ লোকের মধ্যে হতো, তাহলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির পরিমাণও ১০০ গুণ কমে যেত। তা ছাড়া, এত বৃহৎ সংখ্যার ভোট গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেয়া যত কঠিন, ১০ লাখ লোকের সমাগমে সেই পরিস্থিতি শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব। এবার ভোটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটার সংখ্যার ফারাক ছিল বিস্তর। আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিচে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে পারেন রাষ্ট্রীয় অভিভাবকেরাÑ
প্রথম : প্রতিবেশী ভোট/আস্থা ভোট/ ওয়ারিশ ভোট/ বংশ ভোট অর্থাৎ আশপাশের প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন হতে ১০০-৩০০ জনের ভোটে ১-৩ জনের একটি আস্থা নেতৃত্বের প্যানেল তৈরি করা যায়। যারা জাতীয় নির্বাচনে সরকার গঠনে সরাসরি ভোট দেবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপক বা গণমানুষের অংশগ্রহণে ব্যাপক বা গণশত্র“তার সৃষ্টি হবে না। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাপক ধরপাকড়, লাখ লাখ সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে মামলা বা নির্বাচনী সহিংসতা অনেকাংশে কমবে। ১০ কোটি ভোটারকে নিয়ন্ত্রণ করা যত কঠিন সেক্ষেত্রে ১০ লাখ ভোটারকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ।
দ্বিতীয় : প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাপক ধরপাকড়ের কারণে অনেক রাজনীতিবিদ নির্বাচনের আগে কারাগারে আটক থাকেন, সেক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের ভোট নেয়া খুবই জরুরি। কারণ, রাজনীতির কারণেই তারা কারাবন্দী। অন্য দিকে আস্থা ভোটার ব্যবস্থার প্রচলন হলে এবং কারাগারে ভোট নেয়ার ব্যবস্থা থাকলে প্রতিপক্ষ আস্থা ভোটারকে কারাগারে আটকে রাখার আগ্রহ হারাবে। যেহেতু আস্থা ভোটার সংখ্যা অনেক কম এবং তাদের কারাগারে আটক করলেও জাতীয় নির্বাচন প্রভাবিত হবে না (যেহেতু তারা কারাগারে ভোটাধিকার পাচ্ছে) সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মামলা বা গ্রেফতারি হয়রানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমবে।
তৃতীয় : আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ক্রমিক সম্মানীয় পদমর্যাদা আছে, আবার রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় ভোটে ন্যূনতম বয়স ১৮। তা ছাড়া, এই রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অফিসে কারো বেতন প্রথম গ্রেডে আবার কারো বেতন ২০তম গ্রেডে। অর্থাৎ একই সময় ব্যয় করে কেউ পাচ্ছে ৮২৫০ টাকা আবার কেউ পাচ্ছে ৭৮০০০ টাকা। জ্ঞান, বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতা বিবেচনায় এটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। জীবনের সব জায়গায় গ্রেডিং গ্রহণযোগ্য হলে গণতান্ত্রিক ভোটেও তা গ্রহণযোগ্য করা যায় কি না ভাবা উচিত। যেমনÑ প্রধান বিচারপতি, বরেণ্য রাজনীতিবিদ, দেশখ্যাত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনবিদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বা অন্য কোনো পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির ভোট একটি। অন্য দিকে সদ্য কিশোর-কিশোরী (প্রথম ভোটার), ঘরের গৃহিণী, স্বশিক্ষিত বা জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত শ্রমিক শ্রেণী যাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে ধারণা খুব কম তাদের ভোটও একটি। সেক্ষেত্রে সবার মতামত এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ভোটিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রেডিং আনা যায় কি না ভাবা উচিত।
চতুর্থ : বর্তমান ব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচন একটু ভিন্ন ধাঁচে করা সম্ভব। সারা দেশে একসাথে ভোট গ্রহণ না করে আটটি বিভাগে, উপজেলা নির্বাচনের মতো চার-পাঁচ ধাপে ভোট গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ভোট গণনা এক দিনেই হবে। বিভাগীয় ভোট কাস্টিং ব্যালট বাক্স সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশনে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বে লক-আপ (নিশ্চল রাখা) করে রাখা। পরবর্তীকালে সব বিভাগীয় ভোট কাস্টিং সম্পন্ন হলে সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে এক দিনেই ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করা যাবে। চার-পাঁচ ধাপে ভোট কাস্টিং হলে সমগ্র দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ শক্তি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রয়োগ হলে সহিংসতাহীন নির্বাচন সম্ভব।
পঞ্চম : নির্বাচনী ভোট কাস্টিং অ্যাপসের মাধ্যমে এনআইডি বা ভোট নম্বর প্রয়োগ করে জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিনে একটি অনলাইন ছায়া ভোটের আয়োজন করা। অর্থাৎ ঘরে বসে বা যেকোনো জায়গা থেকে নিজের এনআইডি বা ভোট নম্বরের বিপরীতে নিজের ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রয়োগ করে ভোট দিতে পারবে। বর্তমান ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন খুবই সহজলভ্য এবং তা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে ফোন কোম্পানিগুলোর বদলৌতে পৌঁছে গেছে। নির্বাচন কমিশন/এনজিও/রাজনৈতিক দলগুলো খুবই স্বল্প বাজেটে বাংলাদেশের সব অঞ্চলে ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন পৌঁছে দিতে পারবে। অনলাইন ভোটিং অনেকটা অনলাইন শিক্ষক নিয়োগ/ভার্সিটি ভর্তি/অনলাইন টেন্ডারের মতো শুধু ব্যক্তিগত আইডেন্টিটি নম্বর সব নিয়ন্ত্রণ করবে অর্থাৎ কারো পেশিশক্তি এখানে কাজে লাগবে না। এই অনলাইন ভোটিংয়ের অ্যাডমিন প্যানেল হাইকোর্টের পাঁচ-সাতজন বিচারপতি বেঞ্চের যৌথ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, যাতে ভোটিং ব্যবস্থা শতভাগ সচ্ছতা বজায় থাকে। ছায়া ভোটটি জাতীয় নির্বাচনের ভোটের সাথে ক্রসম্যাচিং করে যদি ৫-৭ শতাংশের ওপর অসঙ্গতি পাওয়া যায়, তবে তা বিচার বিভাগীয় তদন্তযোগ্য হবে। আর দু’বছর পর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে অথচ বর্তমান সরকারের সাথে বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপির সম্পর্ক ইতিহাসের সবচেয়ে তলানিতে, যা কারো জন্যই সুখকর নয়। সরকারকে এ ক্ষেত্রে বিএনপির জন্য স্পেস (জায়গা) তৈরি করে দিতে হবে। অন্য দিকে বিএনপির আসন সংখ্যা যাই থাকুক, ব্রিটিশ সংসদের আদলে আমাদের সংসদেও বৃহত্তর দল হিসেবে বিএনপির একটি ছায়া মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা উচিত। বৃহত্তর দল হিসেবে বিএনপি ভবিষ্যতে যাদের যে মন্ত্রণালয় দেবে বলে পরিকল্পনা করছে, তাই ছায়া মন্ত্রিপরিষদ। ছায়া মন্ত্রীরা হোমওয়ার্কিং করে বর্তমান মন্ত্রীদের আলোচনা, সমালোচনা, ভুলভ্রান্তি, বাজেট বা পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূর। হ
লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক faimfaohan19121@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement