২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতীয় বীর নবাব সিরাজউদ্দৌলা

নবাব সিরাজউদ্দৌলা - ছবি : সংগৃহীত

নবাব মনসুর উল মুলক মির্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা হয়বত জঙ্গ বাহাদুর নানা আলিবর্দী খানের হাত ধরে সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল। বাংলা বিহার উড়িষ্যার তিনি নবাব হন মাত্র ২৩ বছর বয়সে। ২ জুলাই ১৭৫৭ পর্যন্ত ১৪ মাস ১৪ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।

২৬২ বছর আগে পলাশীর প্রান্তরে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সিরাজউদ্দৌলার অমাত্যবর্গ ও আত্মীয়স্বজন, তার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ।

সিংহাসনে বসেই সিরাজউদ্দৌলা জানতে পারেন, চার দিকে আপনজনেরাই শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা অত্যন্ত স্নেহ করে তাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এটা পছন্দ হয়নি খালা ঘসেটি বেগমের, মেজ খালার ছেলে শওকত জংয়ের। এই সুযোগ গ্রহণ করল ইংরেজরা। ৯ এপ্রিল নানার মৃত্যুর পর থেকেই ষড়যন্ত্রের শুরু হলো। পত্রের মাধ্যমে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল শওকত যে, সে সিরাজের নবাবী মেনে নিয়েছে, কিন্তু তা ছিল মিথ্যা আশ্বাস। এ সময় পূর্ণিয়ার গভর্নরের দায়িত্বে ছিল সে।

৫ জুন সিরাজ রওনা হলেন কলকাতা অভিমুখে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সাথে রসদ খোরাক ও মালসামান নিয়ে। ১১ দিনে ১৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে, ১৬ জুন পৌঁছলেন কলকাতায়। যুদ্ধ হলো ইংরেজ বাহিনীর সাথে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ইংরেজরা অবৈধভাবে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করেছিল। সিরাজ স্বয়ং যুদ্ধে অংশ নিয়ে, তিন দিন যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত এবং ওদের কয়েকজন নেতাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদ ফিরে যান।

শওকত জং এ দিকে শঠতামূলক শান্তির আশ্বাস দিয়েও দিল্লির পুতুল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুবাদারি ফরমান পেয়ে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসার ষড়যন্ত্র করছে- এ খবর পেয়ে সিরাজ তাকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে ১৫০ মাইল দূরে অবস্থিত, পূর্ণিয়া অভিমুখে ২৪ সেপ্টেম্বর সসৈন্য রওনা হন এবং শওকত জংয়ের সেনাপতি শ্যামসুন্দরের মোকাবেলা করলেন। ৩ নভেম্বর নবাব মুর্শিদাবাদ ফিরলেন। নবাবকে এক বছরে বিভিন্ন যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে প্রধান সিপাহসালার মীর জাফর এবং অমাত্য রায়দুর্লভ ও রাজবল্লভের বিরুদ্ধে। জগৎশেঠও ছিল নবাবের শত্রু।

চার দিকে ষড়যন্ত্রে দিশাহারা অবস্থায় নবাব দেশরক্ষায় উপস্থিত হলেন পলাশীর আমবাগানে। যুদ্ধের এক মহানাটক অনুষ্ঠিত হলো। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ‘পরাজিত’ হলেন। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলো।

ইংরেজ বেনিয়াদের এক বখাটে তরুণ ক্লাইভ ছিল মায়ের খেদানো, বাবার তাড়ানো। ভারতে এসেছিল বার্ষিক ৮০ টাকা বেতনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে। রাতারাতি হয়ে গেল ইংরেজ বাহিনীর কূটচক্রান্তের অন্যতম হোতা। ইংরেজ ও নবাবের অমাত্যবর্গের সাথে ষড়যন্ত্রের নেতৃত্বদানে সে ছিল প্রধান। ৪ জুন ১৭৫৭ সালে ইংরেজ ও অমাত্যবর্গের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল সে। জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদসহ ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পেরেছিল নবাব পদের জন্য একজন মুসলমান নামধারী, অযোগ্য ব্যক্তি প্রয়োজন। সেজন্য তারা প্রথমে শওকত জংকে বেছে নিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর খুঁজে বের করল মীর জাফর আলী খানকে। তিনি বয়সে বৃদ্ধ এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ।

দুই.
সিরাজকে হত্যার পর ইংরেজ ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম খলনায়ক ডা: হলওয়েল একটি প্রবন্ধ লিখে নবাবের চরিত্র হননের চেষ্টা চালায়। দাঁতের ডাক্তার এই ব্যক্তি লিখেছে, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে সিরাজ বিজয়ের পর সেখানে ১৩দ্ধ১৮ ফুট আয়তনের একটি ঘরে জানালাহীন একটি ছোট্ট কামরায় ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করে রেখেছিলেন, তাদের ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে। আসলে এত ছোট্ট রুমে ১৪৬ জন লোককে ঠেসে ভরলেও যে আঁটানো যায় না এবং তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেননি। হলওয়েল এর নাম দিয়েছে অন্ধকূপ হত্যা। প্রকৃত ঘটনা হলো, সেদিন যুদ্ধ শেষে সন্ধ্যাবেলায় সুস্থ ও আহত মিলে মাত্র ৩৯ জন ইংরেজ সৈনিককে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। দ্বাররুদ্ধ ছিল না; প্রহরী মোতায়েন ছিল। চিকিৎসার অভাবে রাতে ১৮ জন বন্দী মারা যায়।

সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর বেশ কিছু হিন্দু বুদ্ধিজীবী ইংরেজ বেনিয়াদের সমর্থন দিয়ে তাকে হেয় করতে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করে গল্পমূলক ‘ইতিহাস’ লেখেন। বলা হলো, সিরাজ মদ্যপ ছিল, ছিল নারীলিপ্সু। শচীন সেনগুপ্তের সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি গ্রামে গ্রামে ছিল খুব জনপ্রিয়। সেখানে সিরাজ চরিত্রকে কলঙ্কিত করা হয়েছে।

আলিবর্দী খাঁর কোনো হেরেমখানা ছিল না। তার চরিত্রে লাম্পট্য তো দূরের কথা, জীবনে তিনি মদ স্পর্শই করেননি। এক স্ত্রী নিয়ে তার ছিল সুখী সংসার। ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। সিরাজ যৌবনকালে হেরেম বা সুন্দরী নারীর সংস্পর্শ পাননি। নানা তাকে শৈশব থেকে নিজ আদর্শে গড়ে তুলেছেন। সিংহাসনে বসার আগেই লুৎফুন্নেসার মতো সতী-সাধ্বী নারীর সাথে বিয়ে দিয়েছেন। অথচ ‘বাবু লেখক’রা তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে তাকে উচ্ছৃঙ্খল লম্পট ও মাতাল বলে চিত্রিত করেছে।

তিন.
১৭৫০ সালে সিরাজের বাবা জয়নুদ্দীনকে ষড়যন্ত্রকারীরা যখন হত্যা করে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। এ বয়সেই আলিবর্দী খানের নির্দেশে কিশোর সিরাজকে নবাবের তরফ থেকে পাটনার গভর্নরের দায়িত্ব নিতে হয়। অল্প দিনেই এই কিশোর বালকের দক্ষতায় সবাই মুগ্ধ হন।

সিরাজের চারিত্রিক দৃঢ়তা, প্রশাসনিক দক্ষতা, অশ্বচালনা ও যুদ্ধবিদ্যায় খুশি হয়ে আলিবর্দী খান নবাব পদের জন্য উত্তরসূরি নির্বাচন করেন তাকে। তার আরেক নাতি শওকত ছিল মদ্যপায়ী, নারীলিপ্সু। এ কারণেই অযোগ্যতার জন্য তাকে মনোনীত করেননি তিনি বয়সে বড় হলেও।

সিরাজউদ্দৌলার শাহাদতের দেড় শ’ বছর পর কেউ কেউ নাটক লিখেছেন, যা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে জনপ্রিয়তা লাভ করে। গিরিশ ঘোষ, শচীন সেনগুপ্ত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সঠিক ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তান আমলে সিকান্দার আবু জাফর সিরাজউদ্দৌলা নাটক লিখেছেন। তিনি সিরাজের সত্যিকার চরিত্র, বীরত্ব ও রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি ফুটিয়ে তুলেছেন।

সিরাজ আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক। এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত। যদি সেদিন দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল না হতো তাহলে আজ পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর দেশগুলোর মধ্যে এ দেশও পরিগণিত হতো।

বেঈমানদের কারসাজিতে দেশ চলে গেল বিদেশী বেনিয়াদের হাতে। পার হয়ে গেল প্রায় দুই শ’ বছর। সিরাজউদ্দৌলা কারো কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। দেশের জন্য জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন আমৃত্যু বেঈমানদের সাথে। ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে একজন দেশপ্রেমিক বীর হিসেবে।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তার ‘মীর কাসিম’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘এই মানাস্পদ মোগল রাজসিংহাসনের সাথে মীর জাফরের কলঙ্ক কাহিনী চির সংযুক্ত হইয়া রহিয়াছে। হিন্দু কি মুসলমান কেহই মীর জাফরের কথায় বিস্মিত হইতে পারে নাই। পাঁচশত বছর মুসলমানের সম্মুখে কুর্নিশ করিতে করিতে হিন্দু সন্তানের পক্ষে মুসলমান শাসন অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহারা কেহ রাজা, কেহ মন্ত্রী, কেহ সেনাপতি হইয়া মুসলমানের দোহাই দিয়া শাসন ও শোষণকার্য হস্তগত করিয়াছিল। সিরাজউদ্দৌলা তাহার মূলোচ্ছেদের চেষ্টা করায় সকলে মিলিয়া মীর জাফরের সহায়তায় সিরাজউদ্দৌলাকে উচ্ছেদ করেন।

মুসলমানেরা অনেক কালের নবাব। কী ইংরেজ কী বাঙালি সকলেই সে নবাব দরবারে জানু পাতিয়া উপবেশন করিতেন। সিরাজউদৌল্লার পদভারে মেদিনী কম্পিত হইয়া উঠিত। ইংরেজদের কথা বিশেষভাবে আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। বিদেশে বাণিজ্য করিতে আসিয়া যাহার প্রাসাদে এমন স্বর্ণ সিংহাসন কুড়াইয়া পাইয়াছেন, তাহার কথা ইংরেজগণ কোন লজ্জায় এত অল্পদিনেই বিস্মৃত হইবেন? মীর জাফর, কর্নেল ক্লাইভের হাত ধরিয়া একবার মাত্র এই সিংহাসনে পদার্পণ করিলেন। কিন্তু তাহাতে আর অধিক দিন উপবেশন করিতে পারিলেন না। সেই সময় হইতে এই পুরাতন রাজসিংহাসন অযতেœ অনাদরে পড়িয়া রহিয়াছে।’

ঐতিহাসিক ড. মোহর আলী তার ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব গঁংষরসং ড়ভ ইবহমধষ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার স্বল্পকালীন রাজ্য শাসনে দুর্বলচিত্ততা দেখাননি। তাকে বরং যথার্থ রাষ্ট্রনায়কসুলভ দক্ষতা ও দৃঢ়তার অধিকারী শাসক বলেই মনে হয়।’

১৮ মে ১৯৯১ সালে কলকাতার দেশ সাময়িকীতে ‘পলাশী কার চক্রান্ত’? শিরোনামে এক প্রবন্ধে শ্রী সুশীল চৌধুরী লিখেছেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীর জাফরের নয়। জগৎশেঠদের দায় মীর জাফরের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য অংশ নিয়েছে। রবার্ট ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র দেখার পর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, পলাশী চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদদ পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।’

শ্রী সুশীল চৌধুরী বলেন, ‘মুর্শিদাবাদের শাসক গোষ্ঠীর একটি অংশ এবং ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলার অবসান চেয়েছিল বলে পলাশী চক্রান্তের উদ্ভব। উভয়ের কায়েমি স্বার্থের পক্ষে সিরাজউদ্দৌলা ছিল প্রধান বাধা। সমধিক অভিজাত শ্রেণী; ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও জমিদারদের নিবিড় জোটবদ্ধতা বাংলার নবাবের পূর্ণ ক্ষমতার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, সিরাজউদ্দৌলা তা মেনে নিতে মোটেই রাজি ছিলেন না। নবাব হয়েই সিরাজউদ্দৌলা সামরিক ও বেসামরিক উভয় শাসনব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। মোহন লাল, মীর মদন ও খাজা আবদুল হাদি খানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ এই নতুন ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। শাসক শ্রেণীর একটি গোষ্ঠী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আগের নবাবদের আমলে এই বিশেষ গোষ্ঠীই সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে লিপ্ত ছিল। এখন তাদের সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের পথগুলো বন্ধ করে দেবেন। সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে মীর জাফরের অপসারণ, রাজা মানিক চাঁদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি আলিবর্দীর একান্ত বিশ্বস্ত ও প্রভূত ক্ষমতাশালী হুকুম বেগের দেশ থেকে বিতাড়নের মধ্যে শাসক শ্রেণীর কুচক্রী দল বিপদ সঙ্কেত পেয়ে যায়। ঐসব সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় সংযোগ ছাড়া পলাশী বিপ্লব সম্ভব হতো না। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হওয়ার পর ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠে, পাছে নতুন নবাব তাদের দুই কল্পতরু নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার সমূলে বিনাশ করে বসেন। তাই এই তরুণ নবাবকে ধ্বংস করার জন্যই পলাশীর এই চক্রান্ত।’

নবাব তার মনোভাব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। ইংরেজদের রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করার তিনটি কারণ ছিল- ‘প্রথমত, দেশের প্রচলিত নিয়মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাজ্যের মধ্যে তারা সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ ও পরিখা খনন করেছে। দ্বিতীয়ত, তারা দস্তকের সুযোগ সুবিধার যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে এবং যারা কোনোভাবেই এই দস্তক ব্যবহারের অধিকারী নয়, তাদেরও বাণিজ্যবাবদ রাজস্বের প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। তৃতীয়ত, ইংরেজরা নবাবের এমন সব প্রজাকে আশ্রয় দেয় যারা বিশ্বাস ভঙ্গ ও অশ্রাব্য ব্যবহারের জন্য নবাবের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।’

ইংরেজ ঐতিহাসিক লে. কর্নেল ম্যালিসনের মতে, পলাশীর যুদ্ধে নবাব বাহিনীতে ছিল ৩৫ হাজার পদাতিক সিপাহি, ১৫ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য এবং ৫০টি কামান। অপর দিকে, কোম্পানি বাহিনীতে ছিল ৯ হাজার ইউরোপীয় সৈন্য, ১০০ তোপাসী এবং দুই হাজার দেশীয় সিপাহি।

ঐতিহাসিক অশোক মোহন চট্টোপাধ্যায় ‘পলাশীর যুদ্ধ’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র...।’ হিন্দুদের চক্রান্ত হলেও বড় গোছের মুসলমান অন্তত একজন চাই। নইলে সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় বাংলার নবাব হবেন কে? ক্লাইভ তা নিজে হতে পারে না। হিন্দু গভর্নরও কেউ পছন্দ করবেন কি না সন্দেহ। জগৎশেঠরা তাদের আশ্রিত ইয়ার লুৎফ খাঁকে সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় মসনদে বসাতে মনস্থ করেছিলেন। উমিচাঁদেরও এতে সায় ছিল। কিন্তু ক্লাইভ ঠিক করলেন অন্য রকম। তিনি এমন লোককে নবাব করতে চান, যিনি ইংরেজদেরই তাবে থেকে তাদেরই কথা শোনে নবাবী করবেন। ক্লাইভ মনে মনে মীর জাফরকে; বাংলার ভাবী নবাব পদের জন্য মনোনীত করে রেখেছিলেন।’ (পৃ: ১৫৮-১৫৯)।

পলাশী যুদ্ধ নিয়ে ঐতিহাসিক ম্যালিসন বলেন : যুদ্ধ হিসেবে আমার মতে, এটি গৌরব করার মতো কিছু নয়। প্রথমত, এটি ছিল না কোনো নির্দোষ। কে সন্দেহ করবে, সিরাজউদ্দৌলার তিন প্রধান জেনারেল যদি তাদের মনিবের প্রতি বিশ্বস্ত থাকত, তাহলে পলাশীর বিজয় হতে পারত না? মীর মদন (মর্দ্দান) খানের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইংরেজরা কোনো অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। (তখন পর্যন্ত) পশ্চাৎপসারণে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল।

‘...না, তারও অধিক ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ জুনের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির বিচারে বসে নিরপেক্ষ কোনো ইংরেজই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, মর্যাদার মানদণ্ডে সিরাজউদ্দৌলার নাম ক্লাইভের নামের অনেক ওপরে অবস্থিত। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন ওই বিয়োগান্ত নাটকে প্রধান চরিত্রসমূহের মধ্যে একক চরিত্র, যিনি প্রতারণা করতে চেষ্টা করেননি।’ প্রাগুক্ত পৃ: ৭৩ এবং ৭৬।


আরো সংবাদ



premium cement