২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সব সন্ত্রাসবাদ নিষিদ্ধ করা হোক

- ছবি : সংগৃহীত

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলায় নামাজরত ৫১ জন মুসলিমকে হত্যা করার পর ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইস্তাম্বুলে এক সভায় মিলিত হয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যখন এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা করেছেন, তখন পশ্চিমা অনেক রাজধানী এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডকে সেভাবে চিহ্নিত করা থেকে বিরত ছিল। এ ব্যাপারে ভারত যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাতে মুসলিম বা মসজিদের কথা উল্লেখও করা হয়নি।

আমেরিকায় ৯-১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে প্রধানত কথিত ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদে’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ আলকায়েদা এবং ৯-১১ হামলার সাথে জড়িত সব সংগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। পাল্টা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিশেষভাবে ‘ইসলামপন্থী গ্রুপ বা দল এবং ব্যক্তিদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আলকায়েদা এবং তাদের সহযোগীরা ছাড়াও ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান এবং পূর্ব তুর্কমেনিস্তান ইসলামী আন্দোলন এবং জয়শ-ই-মোহাম্মদকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করা হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে ২০০৭ সালে হত্যা প্রচেষ্টার পর জয়শ-ই-মোহাম্মদকে এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর লস্কর-ই-তৈয়্যবাকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের আওতায় তালিকাভুক্ত ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন, সমর্থন এবং সহযোগিতা করার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের ওপর ব্যাপক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিমরা কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটালে তারা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকুক বা না থাকুক তাদের ওই কাজকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে বর্ণনা করা হয়। একটি কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্য চাঁদা চাইলে বা ওই সংগঠনকে সমর্থন করলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়- এমনকি ওই কাজের পরিণামে তাদের বিরুদ্ধে হামলা পর্যন্ত চালানো হয়। অপর দিকে অমুসলিমরা একই ধরনের অপরাধ করলেও তাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে তিরস্কার করার তেমন কোনো নজির নেই।

পাকিস্তানসহ ওআইসির সদস্যভুক্ত কয়েকটি দেশ এ ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আগেই কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০০৫ সালের জাতিসঙ্ঘ শীর্ষ সম্মেলনে একটি ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানানো হয়েছিল। শীর্ষ সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক কনভেনশনও গৃহীত হয়।

জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের একটি কমিটি ২০০৬-৭ সালে কনভেনশনটি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু কয়েকটি বড় শক্তি এবং ভারত ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ এবং সন্ত্রাসবাদের মূল কারণকে কিভাবে সম্বোধন করবে তা নিয়ে ঐকমত্য পোষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কনভেনশনটি অনুমোদিত হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন সব আপত্তি পরিত্যাগ করে কথিত ‘র‌্যাডিক্যাল ইসলামিক টেরোরিজমের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মুসলিমবিরোধী এই ফোকাসকে ভারত এবং কয়েকটি রাষ্ট্র (যেসব দেশে মুসলিমদের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন চলছে) আগ্রহসহকারে স্বাগত জানায়।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচারণা মিশ্রভাবে সফলতা অর্জন করেছে। আলকায়েদাকে প্রায় নির্মূল করে দেয়া হয়েছে এবং উগ্রবাদী ইসলামিক স্টেট গ্রুপকে ভূখণ্ডগতভাবে পরাজিত করা হয়েছে। এ দিকে বিদ্রোহী মুসলিম গ্রুপগুলো অঙ্কুরিত হতে থাকে এবং মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সন্ত্রাসবাদ দমনের ছদ্মাবরণে কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের মতো মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের বৈধ অধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মতো কিছু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। কাশ্মিরিদের মতো কিছু মুসলিম পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ অথবা গণহত্যার মুখোমুখি। আর ভারতের উগ্র হিন্দুরা মুসলিমদের তাদের অধীনে উপনিবেশ হিসেবে রাখার পরিকল্পনা করছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত দখলদারিত্ব ও নির্যাতন-নিপীড়ন এবং এমনকি, পবিত্র জেরুসালেমকে ইসরাইল জোরপূর্বক দখল করার ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিশ্ববিবেক এর বিরুদ্ধে আশানুরূপ সাড়া দেয়নি।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্থূল বৈষম্যকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তোলা হয়েছে। মুসলিম উদ্বাস্তু আর অভিবাসীরা আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক নিয়মবিধির বিপরীতে, পশ্চিমা সীমান্ত থেকে ফিরে আসছে। পশ্চিমা বিশ্ব সমেত সবখানে ইসলামকে অপমানিত এবং ইসলামভীতি সৃষ্টি করাকে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে নেয়া হয়েছে। এতে করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে- যার ফলে সংঘটিত হয়েছে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে ৫১ জন মুসলিম হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা।

ওআইসির দেশগুলো দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এলেই মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এই আন্তর্জাতিক কলঙ্কিত ও দানবীয় কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করা যাবে। সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে একটি ‘ব্যাপকভিত্তিক কনভেনশন’ পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান শুরু করার জন্য এটা হতে পারে একটি ভালো সুযোগ।

ওআইসি দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে কনভেনশন অবশ্যই প্রথমে সন্ত্রাসবাদের আইনগত সংজ্ঞার ব্যাপারে একমত হতে হবে। জাতিসঙ্ঘ সনদের নীতি অনুযায়ী, ওই সংজ্ঞায় অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদকে বাইরে রাখা যাবে না। কয়েকটি বড় শক্তি সেনাবাহিনীকে কনভেনশনের আওতার বাইরে রাখতে চাইলে সেটা বাদ দেয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- এর মাধ্যমে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং বিদেশী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কোনো সমঝোতা অথবা জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের বৈধ অধিকারকে সঙ্কুচিত করা যাবে না।

কনভেনশনে অথবা অন্ততপক্ষে এর সাথে যে প্রস্তাব গৃহীত হবে তাতে অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতাকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে সুস্পষ্টভাবে নিন্দা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নব্য নাৎসি এবং ইউরোপের ফ্যাসিবাদী গ্রুপ এবং আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে তাদের সহিংস কার্যক্রমকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে ধিক্কার জানাতে হবে। ইসলামী গ্রুপগুলোকে যেভাবে ‘সন্ত্রাসী’র তালিকাভুক্ত করা হয়, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদেরও সেভাবে আখ্যায়িত করতে হবে।

একইভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘসহ চরমপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোকেও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের আদর্শ হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদ, ঘৃণা ও সহিংসতা উসকে দেয়া। গান্ধীকে গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে তারা নিজেদের সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। গুজরাটে মুসলিম হত্যা, পাকিস্তানে ‘সমঝোতা’ এক্সপ্রেসে হত্যাকাণ্ড, কাশ্মিরিদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা, গরুকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মুসলমানদের পুড়িয়ে হত্যা, দলিত, আদিবাসীসহ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, সাংবাদিক ও বিরোধী দল-মতের রাজনীতিকদের হত্যা করা, ইত্যাদি তাদের আদর্শিক কর্মকাণ্ড।
এসব সন্ত্রাসী সংগঠনকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অথবা সাধারণ পরিষদের কমিটি গঠন করতে হবে।

লেখক : জাতিসঙ্ঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
‘ডন’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement