২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাশ্মির একটি কারাগার

কাশ্মির একটি কারাগার - ছবি : সংগ্রহ

কাশ্মিরিরা যে গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং নির্যাতনে ভুগছে তা সবাই স্বীকার করেছে। এই বিচ্ছিন্নতা এবং নির্যাতন নিষ্পেষণে তারা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। কিন্তু সেখানে আরেকটি দিক রয়েছে যা প্রায় সময়ে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ওই দিকটি হলো, তারা বাস্তবে একটি বন্দিশিবিরে কারারুদ্ধ বা বন্দী রয়েছে বলে মনে করে। ভারতকে রক্ষা করার জন্য এই বন্দিশিবির থেকে বের হওয়ার সব রুট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভয়ানক বিপদ ছাড়াই কাশ্মিরিদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ভারতের বহু জায়গায় কাশ্মিরিদের, তারা ছাত্র বা ব্যবসায়ী যাই হোন না কেন, বিশ্বাস করা হয় না এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়। এখন এমনকি, আজাদ কাশ্মিরের সাথে নিয়ন্ত্রণ রেখার এপার-ওপারে কদাচিৎ যে ব্যবসায় ও বেচাকেনা হতো, তাও ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এসব ব্যবসায় বা কেনাবেচা শুরু হওয়ার পর থেকে গত এক দশকে তাতে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। সবসময় এসব ব্যবসায় পরিচালিত হয়েছে পণ্যদ্রব্য অদল-বদল বা বিনিময়ের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন এবং টেলিযোগাযোগ সুবিধাদানের ব্যাপারে সবসময় অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রথমে আস্থা সৃষ্টির পদক্ষেপ হিসেবে এ ধরনের ব্যবসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার উত্তরসূরি মনমোহন সিং নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ব্যবসায় চালু না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যবসায় সম্পর্কে দ্রুত জানানোর ব্যবস্থা করেন। এর রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনাযোগ্য। নিয়ন্ত্রণ রেখার ব্যবসা জম্মু এবং কাশ্মির উপত্যকায়ও জনপ্রিয় ছিল। অবশ্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজনের কারণে এই ব্যবসার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। তা সত্ত্বেও ব্যাংকিং ও টেলিযোগাযোগ সুবিধা দিয়ে এই ব্যবসার উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কয়েক বছর আগে মুফতি মুহাম্মদ সাঈদ প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হলে এই ব্যবসা হাস্যকর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা নদীর একটি সেক্টরে বিভাজন খুব সামান্য। বিভক্ত পরিবারগুলো এটা আবিষ্কার করে যে, তারা খুব সহজেই একে অপরের কাছে গিফট বক্স নিক্ষেপ করতে পারবে। তখন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এই ব্যবসা সমৃদ্ধি লাভ করে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী এর অবসান ঘটায়। নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল একটি মিথ্যা অজুহাত। জনতাকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে এবং গিফট বক্স বা উপহার সামগ্রীকে যথাযথভাবে তল্লাশি করা যাবে। এটা ছিল ‘অপর পক্ষের’ উদ্বোধনী- যা ছিল অগ্রহণযোগ্য।

এটা হচ্ছে সেই মানসিকতা, যা নিয়ন্ত্রণ রেখা বাণিজ্যকে ‘ক্রমান্বয়ে বিষ প্রয়োগে হত্যার’ জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। কাশ্মিরের একজন সংবাদদাতা হিসেবে ইশফাকুল হাসান অতি সম্প্রতি শ্রীনগর থেকে এই খবর দিয়েছেন। নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যকার বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে গোটা জম্মু ও কাশ্মিরের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর আন্তঃবাণিজ্যকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘সব আস্থা সৃষ্টিকারী পদক্ষেপের মা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নিয়ন্ত্রণ রেখা বাণিজ্যের ব্যাপারে নয়াদিল্লির পরিকল্পিত অনীহা বা উদাসীনতার কারণে অনেক প্রতিবাদের কথা শোনা গেছে। জম্মু চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট রাকেশ গুপ্ত কড়া ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, ১০ বছর আগে ভারত ও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আস্থা সৃষ্টিকারী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন যথাযথভাবে ফলোআপ না করার কারণে ধীরে ধীরে এর মৃত্যু ঘটছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার কারণে কাশ্মিরি জনগণের ওপর এর প্রভাব পড়েছে এবং ইতোমধ্যে কাশ্মিরিদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। তাদের জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই একটা পথ যে প্রস্তাবের মাধ্যমে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। এখন তাদের মুখের ওপর সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে।

উপমহাদেশের কোনো অংশে কাশ্মিরের মতো এ ধরনের কোনো ইতিহাস নেই। একইভাবে মহারাজা এবং কাশ্মিরের জনগণ ব্রিটিশ শাসকদের অগ্রাহ্য করে, বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন- এ ধরনের ঘটনা অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সম্রাট আকবর গোটা উপমহাদেশ করায়ত্ত করেছিলেন। কিন্তু কাশ্মিরিরা ১৫৮৬ সালে স্বাধীনতা নস্যাৎ করে তাদের ভূমি দখল করার জন্য সম্রাট আকবরকে ঘৃণা করে। তিনি কাশ্মিরের শেষ শাসক ইউসুফ চাককে ভারতের প্রতি প্রলুব্ধ এবং তাকে হত্যা করেছিলেন। ইউসুফ চাককে বিহারে সমাহিত করা হয়। অত্যাচারী ও নিষ্ঠুরদের বিরুদ্ধে প্রচলিত একটি অস্ত্র হিসেবে মুঘল সৈন্যরা পাথর নিক্ষেপের শিকার হয়েছে কাশ্মিরিদের দ্বারা।

কাশ্মিরিরা এখনো সেই সময়ের কথা স্মরণ করে। এমনকি, স্বৈরাচারী ডোগরা শাসকেরা এবং তাদের ব্রিটিশ লর্ডসদের শাসনের কথা স্মরণ করেন- যখন রুশ এবং মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীরা কাশ্মিরের বিশ্ববিখ্যাত শালের জন্য এই অঞ্চলে আসতের। মধ্য এশিয়া এবং কাশ্মিরের মধ্যে তখন তীর্থযাত্রী, বই, শাল, স্বর্ণের টিলা (Gold tillas), রাশিয়ান কাপড়, কোকান্দি সিল্ক, লাল বা গোলাপ রঙের বুখারার রুমাল ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও উপাদান আদান প্রদান হতো। ব্রিটিশরা অন্যান্য দেশের সাথে মহারাজার যোগাযোগের বিষয়টি চিহ্নিত করার জন্য তার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ব্রিটিশ ভারত থেকে ব্যবসা বাণিজ্য চালানো হতো চাং চেন মো রুট দিয়ে কুলু হয়ে ইয়ারকন্দ পর্যন্ত। ওই সময় হতে মহারাজার কাস্টমস কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করা হতো। এই ধারণাটি এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, ১৮৭০ সালে ভাইসরয় লর্ড মেয়ো এবং মহারাজা রণবীর সিং শিয়ালকোটে একটি বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে এই রুটটিকে ‘মুক্ত মহাসড়কের’ মর্যাদা দেয়া হয়। চুক্তিতে সরবরাহ ডিপো এবং রেস্ট হাউজগুলো ব্রিটিশ কাশ্মিরি কর্মকর্তারা যৌথভাবে তত্ত্বাবধান করার বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই সড়কটি ‘চুক্তি রুট’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। মধ্য এশিয়া থেকে হজযাত্রীরা কাশ্মির দিয়ে জাহাজে করে করাচি অথবা মুম্বাই হয়ে যাতায়াত করতেন।

এখনো কাশ্মিরিরা ওই ইতিহাস স্মরণ করে থাকে। ১৯৭০ সালে এই লেখক একটি নামকরা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদককে সাথে নিয়ে শ্রীনগরের একেবারে ভেতরে ভ্রমণ করেছেন। হঠাৎ তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা ভারত নয়, মধ্য এশিয়া।’

সাংবিধানিক নির্যাতন ছাড়াও কাশ্মিরিদের অবশ্যই শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে হবে এবং তাদের স্বাধীনভাবে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে। তাহলে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ সহজ হবে। জম্মু-শিয়ালকোট সড়ক দিয়েই এই প্রচেষ্টা শুরু করা যেতে পারে।
লেখক : গ্রন্থকার ও মুম্বাইভিত্তিক আইনজীবী
ডন থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement