২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উল্লাস বনাম ফরিয়াদ

-

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান যথার্থই বলেছেন, ‘আরাকান ও ফিলিস্তিনি মুসলমানদের চোখের অশ্রু মুসলিম উম্মাহর বেদনার অংশ।’ আমাদের প্রিয়নবী সা: বলেছেন, ‘মুমিনের শরীরের দু’টি ফোঁটা রাব্বুল আলামিনের নিকট অধিক প্রিয়; একটি শহীদের বুকের ঝরে পরা রক্ত; অন্যটি মুমিনের চোখের অশ্রু।’ সব মহাদেশই আজ নির্যাতিত মুসলমানদের কান্নার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কোথাও তারা সরাসরি অবিশ্বাসী শাসকদের নিপীড়নের শিকার, কোথাও মুসলিম নামধারী স্বৈরাচারী অত্যাচারে আর্তনাদ করছে। এক পরিসংখ্যান মোতাবেক, যুক্তরাষ্ট্রের ‘১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার’ পর বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম জনপদের দুই কোটি সত্তর লাখ মুসলমানকে বিভিন্ন পন্থায় হত্যা করা হয়েছে।

উপমহাদেশে কাশ্মিরে মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর চলছে নিদারুণ নির্যাতন। আমাদের পাশের আসামে মুসলিম নাগরিকদের একটি বৃহৎ অংশের স্বীকৃতি নেই আরাকানে হরণ করা হয়েছে মুসলমান এবং বাসিন্দা থাকার অধিকার। যুগের পর যুগ আফগানিস্তানে চলছে আগ্রাসন। চীনের জিন জিয়াং প্রদেশের মুসলমানদের ধর্মকর্মের সুযোগ নেই। এদিকে, বর্ণবাদী ইসরাইল কর্তৃক প্রায় প্রতিদিন শহীদ হচ্ছেন ফিলিস্তিনি যুবকেরা। ইরাক ও সিরিয়াতে চলছে মার্কিন ও রুশ যৌথ অস্ত্রের খেলা। নিহত হচ্ছে নারী-পুরুষ মুসলিম। কত মানুষ পঙ্গু ও ইয়াতিম হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রসহ কয়েকটি দেশ থেকে চলছে মুসলিম বিতাড়ণের তাণ্ডব। জওহর দুদায়েভকে হত্যা করে চেচনিয়াকে দমিয়ে দেয়া হয়েছে আগেই। ইরানের ওপর চলছে অবরোধ। আমেরিকায় ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে ৯৬ হাজার বোমা ফেলা হয়েছে বিভিন্ন মুসলিম দেশে- এমন অভিযোগ করা হয়েছে।

মিসর, ইয়েমেন, তাজিকিস্তান, কাজাখিস্তান, পাকিস্তানসহ বহু দেশে চলছে ‘মুসলিম কর্তৃক মুসলিম’ নিপীড়নের উল্লাস। অত্যাচার নির্যাতন হলো- ফেরাউন এবং নমরুদদের কাজ। তাই রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে জালিমের সাথে থেকে তাকে শক্তি জোগায়; অথচ তার জানা আছে যে, লোকটি জালিম তাহলে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে।’ (মিশকাত পৃষ্ঠা-৪৩৬) মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, হাফিজুল কুরআন, ড. মুহাম্মদ মুরসিকে, মাত্র এক বছরের মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আধুনিক মিসরের ফেরাউনতুল্য সেনাপতি আবদুল ফাত্তাহ সিসি ক্ষমতা দখল করে নিলো। এবার সাংবাদিক খাশোগিকে নিমর্মভাবে হত্যা করা হলো। মুসলিম, অমুসলিম এমনকি কোনো প্রাণীকেও অন্যায়ভাবে যন্ত্রণা দেয়ার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি।

পৃথিবীর সব নির্যাতিত মুসলিম যুবকের আদর্শ হচ্ছেন রাসূল সা:-এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও হোসাইন রা:। কর্তব্য কারবালার প্রান্তরে ৭০ জনের নিরস্ত্র কাফেলা নিয়ে হোসাইন রা: যখন দেখলেন, অস্ত্রসজ্জিত চার হাজার সৈন্য ঘেরাও করে রেখেছে মরুপ্রান্তর, তখন তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যথাক্রমে আমাকে মদিনায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দাও। অথবা আমাকে শাসক ইয়াজিদের সাথে আলোচনার সুযোগ দাও। কিংবা আমাকে অন্য কোনো সীমান্তে চলে যাওয়ার পথ করে দাও। এর পরেও নেতৃত্বাধীন ইবনে জিয়াদের বাহিনী নিমর্মতার পরিচয় দিলো। দ্বিখণ্ডিত হলো হোসাইন রা:-এর দেহ। আজ ইয়াজিদ ও হোসাইন রা:-তাদের অবস্থান কোথায়? বিশ্বের ত্রিশ লাখ জামে মসজিদে জুমার খুৎবায় একযোগে উচ্চারিত হয় সসম্মানে ইমাম হোসাইনের নাম। তাই আজ যারা বিভিন্ন স্থানে শহীদ হচ্ছেন তাদের পরিবারবর্গের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কাবাঘরের ইমাম ও আসমা রা:-এর সন্তান আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা:-কে শূলে চড়িয়েছিলেন। যারা ইমাম হোসাইন আর ইবনে যুবাইরকে ছেড়ে দেয়নি, তারা বর্তমান বিশ্বে ইসলামি সমাজ কায়েমের আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ছেড়ে দেবে, এটা কিভাবে আশা করা যায়? তাকিয়ে দেখুন চার ইমামের দিকে। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) সরাসরি রাজনীতি না করেও ন্যায়ের পক্ষে ফতোয়া দেয়ার রাষ্ট্র কর্তৃক হয়েছেন মারাত্মকভাবে নিপীড়িত। যে ইমাম বা আলেম সারা জীবন ইসলামের খেদমত করেও সাধারণ মসজিদ কমিটির সদস্য হতে পারেন না তিনি কি বিনা চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে পারবেন?

আমরা কি ভুলে গেছি, কেন ৬১৭ থেকে ৬১৯ সাল পর্যন্ত রাসূল সা: ছিলেন অন্তরীণ। কেন নবীজীকে ৬২২ সালে দেয়া হয়েছিল মক্কার পার্লামেন্ট দারুণ নদওয়া কর্তৃক প্রাণদণ্ডের আদেশ ও পুরস্কার? তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত নবীর প্রার্থনা ছিল ‘হে প্রভু! আমি তোমারই নিকট আমার দুর্বলতাও অপারগতা এবং মানুষের নিকট আমার কদর না হওয়ার অভিযোগ করছি, হে দয়াময় ! তুমি দুর্বলের প্রভু আমারও প্রভু। তুমি আমাকে কাদের নিকট সোপর্দ করছ? এমন কোনো অনাত্মীয়ের কাছে, কি, যে রূঢ় আচরণ করে, কিংবা শত্রুর হাতে, যাকে আমার মাথা মুণ্ডের মালিক বানিয়েছ? যদি তুমি আমার ওপর ক্ষুব্ধ না হও তা হলে এসবের কোনো পরোয়া নেই। কিন্তু তোমার ক্ষমাই আমার প্রকৃত কাম্য। তোমার মুখমণ্ডলের ওই জ্যোতির আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা দ্বারা অন্ধকার আলোকিত হয়েছে এবং পার্থিব ও পারলৌকিক কার্যাবলি হয়েছে সঠিক। তুমি আমার প্রতি শাস্তি অবতীর্ণ করবে, অথবা ধমকাবে উভয় অবস্থায় তোমারই সন্তুষ্টি কামনা করি। সব ক্ষমতা ও শক্তি একমাত্র তোমারই এখতিয়ারভুক্ত। তোমার শক্তি ছাড়া কারোই কোনো শক্তি নেই। (আররাহীকুল মাখতুম পৃষ্ঠা-২৪৬)
একটি মানুষ, একটি সমাজ, একটি দল একটি দেশ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জন্য লড়তে পারে। কিন্তু ইসলামের জন্য সংগ্রাম করলে কেন সে হয়ে যায় কথিত সন্ত্রাসী কিংবা মৌলবাদী? অথচ কানজুল উম্মাল কিতাবের বর্ণনা, ‘ইসলাম ও রাষ্ট্র হচ্ছে যমজ দু’টি ভাইয়ের মতো।’ একটি অপরটির রক্ষক। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন হচ্ছে কোনো না কোনো অপবাদ দিয়ে। যারা স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও দ্বীনের জন্য লড়াই করছেন দেশে দেশে, তাদের বলা হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী। অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে তাদের চরিত্র হননের জন্য। আসলে দাওয়াতি মিশনের জন্য মহানবী সা: হয়েছেন সম্মানিত। সে মেহনত করলে আপনিও হবেন সম্মানিত।

আর যে, সত্য-ন্যায়ের কথাগুলো বলার জন্য রাসূলকে বলা হয়েছে পাগল, জ্বিনে ধরা রোগী, গণক, কবি কিংবা দেশদ্রোহী একই দায়িত্ব যারা পালন করবেন, তারাও হবেন রাসূল সা:-এর পরিবারের মতো নির্যাতিত। তফসিরে কুরতুবী ও মাজহারীতে ইবনে আব্বাস রা:-এর রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, হজরত ইয়াকুব (আ:) এর পরিবারের ওপর চুরির অপবাদ আরোপিত হলে তিনি আজিজে-মিসরের নামে একটি পত্র দিয়েছিলেন। পত্রের বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ :

ইয়াকুব শফিউল্লাহ্ ইবনে ইসহাক যবি: ইবনে ইবরাহীম খলীলুল্লাহর পক্ষ থেকে আজিজে-মিসর সমীপে বিনীত আরজ। বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যেরই অঙ্গবিশেষ। নমরূদের আগুনের দ্বারা আমার পিতামহ ইবরাহীম খলীলুল্লাহর পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। অতঃপর আমার পিতা ইসহাকেরও কঠোর পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। এরপর আমার সর্বাধিক প্রিয় এক পুত্রের (ইউসুফ আ:) মাধ্যমে আমার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। তার বিরহ-ব্যথায় আমার দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে গেছে। তারপর তার ছোট ভাই (বনী ইয়ামিন) ছিল ব্যথিতের সান্ত্বনার একমাত্র সম্বল, যাকে আপনি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করেছেন। আমি বলি, আমরা পয়গম্বরদের সন্তান-সন্তুতি। আমরা কখনো চুরি করিনি এবং আমাদের সন্তানদের মধ্যেও কেউ চোর হয়ে জন্ম নেয়নি। ওয়াস্সালাম। (তাফসিরে মা’আরেফুল কুরআন পৃষ্ঠা-৬৮৮)

আসুন আমরা চার পাশের নির্যাতিত মানুষের জন্য সাধ্যমতো সাহায্য, সমর্থন, সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে আসি। রাসূল সা: বলেছেন, তুমি মুমিন ভাইকে সাহায্য করো, চাই সে জালিম হোক অথবা মজলুম। এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে মহানবী সা: বললেন, জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখাই তাকে সাহায্য করা (মিশকাত পৃষ্ঠা-৪২২)। অর্থহীন বিতর্ক পরিহার করে ‘ইখতিলাফ মাআল ইত্ত্বিহাদ’ সাথে ঐক্য’ নীতির ভিত্তিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি। মহানবী সা: বলেন, যেকোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেবেন (মিশকাত পৃষ্ঠা-৩২)। আমাদের মায়েদের, মেয়েদের ও বোনদের বলি আপনাদের সন্তানদের জন্য, ভাইদের জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে চোখের অশ্রু ফেলে আবেদন করুন।’ হে পালনকর্তা আমাদের কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দাও এবং মৃত্যুর সময় তোমার অনুগত অবস্থায় বিদায় দাও (সূরা আল-আরাফ)।

লেখক : সাবেক মজলুম খতিব, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ, কিশোরগঞ্জ ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement