২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি জানাজার সাক্ষ্য

-

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ: বলেছেন, আমাদের জানাজা আমাদের সঠিকতার ফায়সালা করবে।’ যখন তিনি ইন্তেকাল করলেন, তখন বাগদাদে লাখ লাখ মানুষ তার জানাজায় শরিক হয়েছিলেন। তার জানাজার মাহাত্ম্য দেখে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। গত ৩ নভেম্বর আকোড়া খাট্টাকে মাওলানা সামিউল হকের জানাজায় অংশগ্রহণকারী একাধিক আলেম আমাকে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ:-এর ওই উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, এ জানাজা দেখুন এবং মাওলানা সামিউল হকের সঠিকতার ফায়সালা করুন।

এ বিশাল জানাজায় অংশগ্রহণকারী বহু লোকেরই মাওলানা সামিউল হকের রাজনীতির সাথে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তারা একজন আলেমে দ্বীনকে এ ধরা থেকে বিদায় দিতে এসেছিলেন, যাকে জুমার দিন (২ নভেম্বর) আসরের সময় শহীদ করা হয়েছে। যারা শহীদ করেছে, তারা এমন এক সময়কে বেছে নিয়েছে, যখন পুরো দেশে রাসূল সা:-এর অবমাননা সমস্যা নিয়ে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। খোদ সামিউল হককেও শাহাদতের কিছুক্ষণ আগে তার জীবনের শেষ ভাষণে এ সমস্যা নিয়ে বেশ অস্থির মনে হচ্ছিল। তার জানাজা অস্থিরতাকে বৃদ্ধির পরিবর্তে তা নিরসনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। মাওলানা সাহেবের শাহাদতের ব্যাপারে নানা ধরনের বিশ্লেষণ হচ্ছে।

কেউ বলেছেন, ‘ফাদার অব তালেবান’ দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। কেউ বলেছেন, তার আকোড়া খাট্টাকের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসা দারুল উলুম হাক্কানিয়া ‘নার্সারি অব জিহাদ’ বা জিহাদের আঁতুড়ঘর ছিল। আর কিছু ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়ের তো এটা মোটেই পছন্দ হয়নি যে, মাওলানা সাহেবকে কেন ‘শহীদ’ বলা হচ্ছে। এটাই সেই উগ্রবাদী চিন্তাভাবনা, যা দিন দিন আমাদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে। যে মাওলানা সামিউল হককে জানি, তিনি সর্বদা হাসিমুখে ভিন্নমত সহ্য করার মানুষ ছিলেন। তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯৮৮ সালে দৈনিক জং লাহোরের সিনিয়র সহকর্মী মরহুম জাভেদ জামাল দিসকাভির মাধ্যমে। ওই সময় মাওলানা সামিউল হককে জেনারেল জিয়াউল হকের জোটভুক্ত মনে করা হতো। আর আমি তৎকালীন সামরিক সরকারের কঠোর বিরোধী ছিলাম। তথাপি মাওলানার সাথে এমন এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেল, যা তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলবৎ থাকে। অকপটে স্বীকার করি, এ সম্পর্ক ধরে রাখার ব্যাপারে মাওলানা সাহেবের ভূমিকাই ছিল বেশি।

তিনি প্রতিটি দুঃসময়ে আমার ডাকা ব্যতীত নিজেই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমার কারণে তিনি যেসব চাপের মুখোমুখি হতেন, তা কখনো বলতেন না। কয়েক বছর আগে সোয়াতে মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর আত্মঘাতী হামলা হলে, নামসর্বস্ব তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান তার দায় স্বীকার করেছিল। আমি ওই হামলার নিন্দা করলে ওই সংগঠনের মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান আমার বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া জারি করেন। এরপর আমার গাড়ির নিচে বোমা রাখা হয়। এহসান এর দায় স্বীকার করেন। ওই সময় মাওলানা সামিউল হক নিজে ইসলামাবাদ চলে আসেন এবং আমাকে বলেন, বলো, কার বিরুদ্ধে কী বলতে হবে। আমি তোমার পাশে আছি।’

করাচিতে আমার ওপর যখন আত্মঘাতী হামলা হলো, তখন তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, তিনি যেন জিয়ো টিভি ও আমার বিরোধিতা করেন। কিছু ‘ইসলামের মুজাহিদ’ যখন আমাদের বিরুদ্ধে গাদ্দারি ও কুফরের ফতোয়া জারি করলেন এবং আমাদের কুশপুত্তলিকাও পোড়ালেন, ওই সময় মাওলানা সাহেব কোনো ফরমায়েশি ফতোয়া দিতে অস্বীকার করেন। ২০১৬ সালে কিছু শক্তিধর মানুষ রিসালত অবমাননার মিথ্যা অপবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। আমি আত্মসম্মানবোধের নামে হত্যার বিরুদ্ধে একটি কলাম লিখলে (কলামটি ‘মেকি আত্মসম্মানবোধ’ শিরোনামে নয়া দিগন্তে ২৮ জুলাই, ২০১৬ সালে প্রকাশ হয়েছে) তাতে রিসালত অবমাননার গন্ধ তালাশ করে আমাকে একটি মামলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়। ওই সময় আরো একবার মাওলানা সামিউল হক আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।

তিনি আকোড়া খাট্টাকের দারুল উলুম হাক্কানিয়া থেকে আমার পক্ষে এক বিস্তারিত ফতোয়া জারি করান। এতে বলা হয়েছে, কোনোরূপ যাচাই ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান বা তার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গোনাহ।’ আমার পক্ষে জামেয়া আশরাফিয়া লাহোর ও জামেয়া নাঈমিয়া লাহোরসহ অনেক মাদরাসা থেকেও ফতোয়া জারি করা হয়, তবে দারুল উলুম হাক্কানিয়া থেকে মুফতি মুখতারুল্লাহ হাক্কানির জারিকরা ফতোয়া বেশ বিস্তারিত ও পরিপূর্ণ ছিল। আর যখন কিছু প্রতাপশালী ব্যক্তি, আমাকে সহযোগিতা করার কারণে মাওলানা সামিউল হকের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন, তখন তিনি তাদের অসন্তোষকে মুচকি হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিলেন।

খোদ সামিউল হককেও তার জীবনে বেশ কয়েকবার মিথ্যা অপবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে এমন একটি মিথ্যা অপবাদ তার ওপর আরোপ করা হয়েছিল, আতাউল হক কাসেমিও যার কথা তার কলামে উল্লেখ করেছেন। মাওলানার ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য দুশ্চরিত্রের এক মহিলাকে তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সে কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। মাওলানা রাজনীতির ময়দানে দুর্বল ছিলেন। বড় বড় দল মাওলানাকে ইসলামের নামে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। কয়েক বছর ধরে মাওলানা সামিউল হক লেখালেখি ও গবেষণার প্রতি বেশ মনোযোগী হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি ১০ খণ্ডের ‘খুতুবাতে মাশাহির’ প্রকাশ করেন, যেখানে হাক্কানিয়ার মিম্বরে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কৃত বয়ান এবং ‘আল হক’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোকে বিষয়ভিত্তিক আকারে সঙ্কলন করা হয়েছে।

‘খুতুবাতে মাশাহির’-এর প্রথম খণ্ডে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম কারী তৈয়ব কাসেমির একটি বক্তৃতা শামিল করেছেন, যেখানে ধর্ম এবং ধর্মীয় নিদর্শনের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আলেমদের একে অন্যের প্রতি বেয়াদবি এবং একে অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করা উচিত নয়। বেশ কিছু ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ি রাহ: ইমাম আবু হানিফা রাহ:-এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, কিন্তু কোথাও সামান্যতম বেয়াদবিকেও স্থান দেননি। একবার কাসেম নানুতুবি দিল্লির ‘লাল কূপধারী’ মসজিদের ইমামের পেছনে ফজরের নামাজ পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কেননা তার কেরাত বেশ সুন্দর।

মাওলানা মাহমুদুল হাসান নানুতুবি সাহেবকে বললেন, ওই ইমাম তো আপনাকে কাফের বলেন। তবুও নানুতুবি পরের ফজর নামাজে শিষ্যদের সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে লাল কূপধারী মসজিদে পৌঁছলেন। নামাজ শেষ হলে মসজিদের ইমাম জানতে পারলেন, তার পেছনে নামাজিদের মধ্যে মাওলানা কাসেম নানুতুবি ও মাওলানা মাহমুদুল হাসানও শামিল হয়েছেন। তিনি বেশ লজ্জিত হলেন এবং তাদের সাথে মুসাফাহা করে লজ্জার কথা প্রকাশ করলেন। নানুতুবি তার ওই ভুল ধারণা দূর করলেন, যার কারণে তিনি তাকে কাফের বলতেন। তিনি যে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর অবমাননাকারীকে কাফের সাব্যস্ত করা ওয়াজিব, তবে অবমাননার সঠিক যাচাইও ওয়াজিব।’ মাওলানা সামিউল হক ২০১৬ সালে তার রোজনামচা প্রকাশ করেছেন। এ রোজনামচা ওই সাহেবদের অবশ্যই পড়া উচিত, যারা মাওলানাকে ‘ফাদার অব তালেবান’ (তালেবানের জনক) বলে থাকেন। মাওলানার বাবা শ্রদ্ধেয় মাওলানা আব্দুল হক সাহেব দরবেশ হাজী তুরাঙ্গযায়ী রাহ.-এর হাতে বায়াত নিয়েছিলেন। খান আব্দুল গাফ্ফার খান (বাচা খান) ও তুরাঙ্গযায়ী রাহ.-এর ভক্ত ছিলেন।

আর মাওলানা সামিউল হক তার রোজনামচায় বাচা খানের সাথে হওয়া ওই কথোপকথন শামিল করেছেন, যেটা হাজী তুরাঙ্গযায়ী রাহ:-এর সশস্ত্র আন্দোলনের ব্যাপারে হয়েছিল। ওই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ খেদানো। এ রোজনামচায় কোথাও ওলি খানের দারুল উলুম হাক্কানিয়ায় আগমনের কথা উল্লেখ রয়েছে, কোথাও রয়েছে আজমল খাট্টাকের কথা, কোথাও হরিপুর কারাগারে মাওলানা মুফতি মাহমুদের সাথে কাটানো বন্দী সময়ের স্মৃতিকথা রয়েছে, কোথাও রয়েছে লাহোরে দাতা গঞ্জবখশ রাহ:-এর মাজারে ফাতেহা পাঠ এবং মাওলানা বাহাউল হক কাসেমির সাথে সাক্ষাতের কথা। ওই রোজনামচায় ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ:-এর শানে কবিতাও নজরে পড়ে। এতে বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত হজরত শাহ আলী বাগদাদী রাহ:-এর মাজার জিয়ারতের কথাও রয়েছে।

মাওলানা সাহেব আফগান তালেবানের ব্যাপারে ইংরেজিতে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বহু আফগান তালেবান তার মাদরাসার সাবেক ছাত্র। তবে তিনি তার মাদরাসার পাকিস্তানি ছাত্রদের আফগানিস্তানে লড়াইয়ের জন্য পাঠাতেন না। মাওলানা সামিউল হকের সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে, তিনি সর্বদা পাকিস্তানের আইনের মধ্যে থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপদেশ দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। খায়বার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে যখন কিছু উগ্রপন্থী পোলিও কর্মীদের ওপর হামলা শুরু করে, তখন মাওলানা সামিউল হক ও মাওলানা ড. আলী শের আলী শাহ পোলিও টিকার পক্ষে ফতোয়া প্রদান করেন।

মাওলানা তার এক ছাত্র মুহাম্মাদ ইসরার মাদানির মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফিকাহ অ্যাকাডেমি জেদ্দা কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ ‘জাদিদ ফিকহি ফায়সালে’ নামে প্রকাশ করালেন এবং তার ভূমিকাও লিখে দিয়েছেন। ওই ভূমিকায় তিনি এ গ্রন্থকে সব দ্বীনি মাদরাসার পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেন। এ গ্রন্থে আধুনিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর সমাধান কুরআন ও হাদিসের আলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। মাওলানার এ ভূমিকা তার নিষ্ঠা এবং ইসলামের সাথে তার গভীর সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। তার এ নিষ্ঠাই আমার মতো দুনিয়াদার ও গুনাহগার মানুষকে তার জানাজায় নিয়ে গেছে। এটা সেই জানাজা, যা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ:-এর ওই কথাকে সত্য প্রমাণিত করেছে- ‘আমাদের জানাজা আমাদের সঠিকতার ফায়সালা করবে।’
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন) পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৫ নভেম্বর, ২০১৮ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement