২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জিসিসির বিভক্তিতে জোড়া লাগবে?

জিসিসির বিভক্তিতে জোড়া লাগবে? - ছবি : সংগৃহীত

সৌদি আরব উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) রিয়াদ সম্মেলনে কাতারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের ক্ষুদ্র কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশ কাতার তেল রফতানিকারক সংস্থাÑ ওপেক ত্যাগ করার ঘোষণা দেয়ার এক দিন আগে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে জিসিসির আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের এই আমন্ত্রণ জানানো হলো। সৌদি বাদশাহ সালমান নিজে এই আমন্ত্রণ জানান। ৯ ডিসেম্বর সৌদি রাজধানী রিয়াদে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সম্মেলনে কাতারের আমির যাবেন কি না অথবা কাতারের কোনো প্রতিনিধিদল সেখানে যাবে কি না তা এখনো পরিষ্কার নয়।

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে কাতারের প্রতি সৌদি নমনীয়তাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কাতারের ওপর সৌদি আরব তার উপসাগরীয় সহযোগী আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরকে নিয়ে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের পর এই প্রথমবারের মতো রিয়াদকে নমনীয় মনে হচ্ছে।

উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ ছাড়াও ওপেকে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করে আসছিল সৌদি আরব। খাশোগি হত্যাকাণ্ড, ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষাবস্থা ও কুয়েতের সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন আর জেরুসালেম ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৌদি প্রশাসন বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। এর বাইরে রাজপরিবার, অভ্যন্তরীণ জনমত ও ধর্মীয় নেতৃত্ব থেকেও এক ধরনের চাপে রয়েছে সৌদি প্রশাসন। সর্বশেষ খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায় থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছুটা মুক্তি দেয়ার পর চাপ খানিকটা শিথিল হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সিআইএ প্রধানের আমেরিকান সিনেটে রুদ্ধদ্বার ব্রিফিংয়ের পর পরিস্থিতিতে বেশ কিছুটা পরিবর্র্তন এসেছে।

এ অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিরসনের ব্যাপারে ট্রাম্পের পরামর্শ রিয়াদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সৌদি আরব যে সময়টাতে নমনীয়তা প্রদর্শন করছে তখন কাতার কি একই মনোভাবের স্বাক্ষর রাখবে? এ ব্যাপারে কিছুটা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে ওপেক থেকে দোহা নিজেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ায়। তেল রফতানিকারক হিসেবে কাতারের অবস্থান খুব বড় নয়। তবে দেশটি বিশ্বের ৩০ শতাংশের বেশি তরল গ্যাস রফতানি করে। গ্যাস রফতানিকারক হিসেবে দেশটি তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় কোনো আঞ্চলিক বা ফোরামের নিয়ন্ত্রণ সম্ভবত চাইছে না।

২০১৭ সালের ৫ জুন কাতারের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করা হয়। উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) প্রধান চার প্রতিষ্ঠাতা দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর কোনো সতর্কতা ছাড়াই এ সময় হঠাৎ কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। একই সাথে জল, স্থল ও আকাশ তিন দিক দিয়ে ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

এ কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল মূলত কাতার সরকারের পতন অথবা অন্ততপক্ষে দেশটির সরকারকে বাগে আনা। তা করতে গিয়ে ১৩টি দাবি দোহার সামনে পেশ করা হয়। এর মধ্যে ছিল কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল আলজাজিরা বন্ধ করে দেয়া, মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং দোহায় তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা। কিন্তু সৌদি জোটের এ দাবির কাছে মাথা নত করেনি কাতার। প্রতিবেশী চার দেশের চাপিয়ে দেয়া অবরোধ নানাভাবে মোকাবেলা করেছে দেশটি। বছর দেড়েক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, কাতারের ওপর সৌদি অবরোধ পুরোই ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে কাতারকে দমাতে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করা হয়, সেখানে অবরোধের মুখে পড়ে বরং ঘুরে দাঁড়িয়েছে কাতারের নিজস্ব শিল্প। প্রতিবেশী চার আরব দেশের আরোপিত বাণিজ্য অবরোধের কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লেও দ্রুতই এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় দেশটি। অবরোধের প্রতিক্রিয়ায় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কাতারের স্থানীয় শিল্প বিকাশের। এতে করে স্থানীয় শিল্পে সমৃদ্ধির পথে রয়েছে উপসাগরীয় দেশটি।

কাতারের শিল্প খাত আগে ছিল অনেকটাই আমদানিনির্ভর। বেশির ভাগ পণ্য আমদানি করা হতো অবরোধ আরোপকারী প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। অবরোধের মুখে পড়ে বিকল্প খুঁজতে শুরু করে কাতার, যার মাধ্যমে অধিক আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে দেশটি। কাতারের রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন এখন বেশ বেড়েছে। কাতারে খাদ্য আমদানির একমাত্র সীমান্তপথটিও বন্ধ করে দেয়ার পরই দেশটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ ইরান ও তুরস্ক।

অবরোধে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জিসিসি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কি না তা নিয়েও এরই মধ্যে সংশয় দেখা দেয়। কাতারের সাথে পুরোপুরি সম্পর্ক ছেদ করে ছয় দেশ নিয়ে গঠিত পিজিসিসির তিন সদস্য সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর দেশটির বিরুদ্ধে কোনো কঠোর অবস্থান নেয়া থেকে বিরত থাকে অপর দুই দেশ কুয়েত এবং ওমান। এর মাধ্যমে মূলত সৌদি আধিপত্য মেনে নিতে অস্বীকার করেছে কাতার, কুয়েত এবং ওমান। কাতারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে সে কথাই হয়তো বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে দেশ দু’টি।

মধ্যপ্রাচ্যের এ পরিবর্তনটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। এ অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশ তুরস্কের সাথেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে তাদের। ফলে তুরস্ক, কাতার, কুয়েত, ওমান ও সুদান মিলে একটি পৃথক বলয়ের উত্থান মধ্যপ্রাচ্যে ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এ বলয়ের দেশগুলো ইরানের সাথে তিক্ততার পরিবর্তে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রাখতে চায়।

এ ধরনের একটি পটভূমিতে সৌদি আরবের নমনীয় অবস্থান দেশটির আঞ্চলিক নেতৃত্ব বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রিয়াদকে ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান ও কাতার অবরোধের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ইসলামিস্ট ও জাতীয়তাবাদীদের সাথে সম্পর্কের মধ্যেও ভারসাম্য আনার প্রয়োজন হবে। ইরান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলো সৌদি আরবের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সৌদ পরিবারের শাসনকে অব্যাহত রাখার পক্ষে। গত এক দশকের বাস্তবতাকে সামনে রাখা হলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নমনীয়তা ও সমঝোতার বিকল্প রয়েছে বলে মনে হয় না। বাদশাহ সালমানের সর্বশেষ উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক বলে মনে হয়। এ উদ্যোগ সফল হলে চূড়ান্ত ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে পারে জিসিসি।


আরো সংবাদ



premium cement