২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জম্মুর হত্যাকাণ্ড

মহারাজা হরি সিং ও প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র - ছবি : সংগৃহীত

লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ভারত ভাগ হওয়া সম্পর্কে বাস্তব সত্যের এমন সম্পদ বিদ্যমান রয়েছে, যা আমরা পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে খুঁজে পাই না। এ অধম কয়েক বছর ধরে ব্রিটিশ লাইব্রেরির সদস্য হয়ে আছি। লন্ডনে যাওয়া হলে প্রথম অবসরেই ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস সেকশনে গিয়ে বসি। কেননা, খোঁজাখুঁজি করলে এখানে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিছু দিন আগে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুযোগ হলে ‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার’ (ক্ষমতা হস্তান্তর) শিরোনামে সঙ্কলিত দস্তাবেজে অখণ্ড ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কিছু গোপন পত্র আমাকে আকৃষ্ট করে। একটি পত্র গোপন ছিল না। এটি ১৯৪৭ সালের ১২ জুলাই মহাত্মা গান্ধীকে লেখা হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল, ‘আপনি কাশ্মির যাওয়ার কষ্ট করবেন না। কেননা মহারাজা হরি সিং মুসলিম লীগের নেতাদেরও ওখানে আসতে বাধা দিয়েছেন। যদি আপনি মহারাজাকে কোনো পয়গাম প্রেরণ করতে চান, তাহলে আমার মাধ্যমে প্রেরণ করতে পারেন।’ কিছু দিন পর মাউন্টব্যাটেন শ্রীনগরে তার প্রতিনিধির কাছে একটি গোপন টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন। ২৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে প্রেরিত গোপন টেলিগ্রামে বলা হয়, ‘জম্মু-কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাককে বলা হোক, আমি গান্ধী বা নেহরুকে কাশ্মিরে প্রেরণ করছি। যিনিই যাবেন, মহারাজার সাথে তার সাক্ষাৎ করাতে হবে।’

এ গোপন টেলিগ্রাম পড়ে আমার মাথায় প্রশ্নের জন্ম হলো, মাউন্টব্যাটেন কায়েদে আজমকে শ্রীনগর যেতে দেননি, তবে কংগ্রেসের নেতাকে ওখানে কেন প্রেরণ করলেন? ১ আগস্ট ১৯৪৭ সালে গান্ধী শ্রীনগর পৌঁছেন এবং তিনি মহারাজা হরি সিংয়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন, হরি সিং যেন ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাকের পরিবর্তে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যকে স্বাধীন রাখার পক্ষে ছিলেন। তার ধারণা ছিল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই মহারাজা তার প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন এবং তার স্থানে মেহের চাঁদ মহাজনকে প্রধানমন্ত্রীরূপে নিযুক্ত করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েই রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি, আইজি এবং ডোগরা সেনাবাহিনীর প্রধান পদে পরিবর্তন নিয়ে আসেন এবং আরএসএসের প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এরপর ওইসব কিছু ঘটল, রামচন্দ্র কাক যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন, গান্ধী ও মহারাজা হরি সিংয়ের যোগসাজশে জম্মুতে মুসলমানদের ওপর এমন আজাব নেমে এলো, ইতিহাসের পাতায় যার কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না।

লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে বিদ্যমান ঐতিহাসিক দস্তাবেজগুলো এ কথা বলে, ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের ওপর পাখতুনখাওয়ার গোত্রগুলোর হামলার কয়েকটি বড় কারণ ছিল। প্রথম কারণ ছিল, সিরহিন্দ শরিফে হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানি রহ:-এর দরগাহর অসম্মান করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১১ অক্টোবর কাবুলে ব্রিটিশ দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশে লন্ডনকে জানান, শূর বাজারের হজরত সাহেবের সাহেবজাদা গজনি ও লোগার পরিদর্শন করেছেন এবং সিরহিন্দ শরিফে দরগাহর লাঞ্ছনার প্রতিবাদে হিন্দু ও শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ ছিল, পুঞ্ছ এলাকায় সুধান গোত্রের অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তারা ডোগরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ওই সুধানদের সাদুজাই গোত্রের সাথে সম্পর্ক ছিল। কেননা তারা উভয়ে পাঠান। কাশ্মির রাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী মেহের চাঁদ মহাজন জম্মু অঞ্চলে মুসলমানদের খতম করার পরিকল্পনা তৈরি এবং আরএসএসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের সেনাবাহিনীর উর্দি সরবরাহ করেন। তিনি মুসলমান পুলিশ কর্মকর্তাদের হত্যা করা শুরু করেছেন। এর পর দাঙ্গা শুরু হয় এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গোত্রীয় সৈন্যরা কাশ্মিরে হামলা করে।

আজাদ কাশ্মিরের সাবেক প্রেসিডেন্ট সরদার মুহাম্মদ ইবরাহীম খান তার ‘দি কাশ্মির সাগা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালের জুলাইতে মুসলিম গণহত্যার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। পুঞ্ছ ও গিলগিট-বালটিস্তানে বিদ্রোহের পর আরএসএসকে উর্দি ও অস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হলো। আরএসএস ডোগরা বাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বরের মধ্যে জম্মুতে সোয়া দুই লাখের বেশি মুসলমানদের হত্যা করেছে।’ ওই মুসলমানদের স্মরণে ৬ নভেম্বর জম্মুর ‘শহীদ দিবস’ পালন করা হয়। এটা সেই সময়ের কথা, যখন পূর্ব পাঞ্জাব থেকে আগমনকারী মুহাজিরদের ওপরও জুলুম-নির্যাতনের পাহাড় আছড়ে ফেলা হয়েছিল। তবে যা কিছু জম্মুর মুসলমান নারী-পুরুষের সাথে ঘটেছে, তা বিবেক গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নয়। আমি দাফন করা মুর্দাকে উৎপাটনে বিশ্বাসী নই; তবে নিউ জেনারেশনকে বলা জরুরি, আমাদের দেশ আল্লাহর একটি নিয়ামত। আর এ দেশ অর্জন করতে আমাদের বড়রা শুধু লড়াই করেননি বরং আমাদের নারীরা তাদের ইজ্জত-আব্র“ও কোরবানি দিয়েছেন। আজকের পাকিস্তানে আমরা যখন একে অপরের রক্ত ঝরাচ্ছি এবং একে অপরের বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া আরোপ করছি, তখন আমাদের সেসব শহীদকে ভোলা উচিত নয়, যারা পরবর্তী বংশধরদের জন্য সব কিছু কোরবানি করেছেন।

আজাদ কাশ্মিরের এক সাবেক জজ মুহাম্মাদ ইউসুফ সাররাফ ‘কাশ্মিরিজ ফাইট ফর ফ্রিডম’ নামে দুই খণ্ডে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি ওই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে জম্মুতে জুলুম-নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীর মৌখিক বর্ণনা রূপে উল্লেখ করেছেন। তিনি আতা মুহাম্মাদ নামের এক মিস্ত্রির কাহিনী লিখেছেন, যে জম্মুর মস্তগড় মহল্লার অধিবাসী ছিলেন। ঈদের দিন এলে আতা মুহাম্মাদ নিশ্চিত হলেন, হিন্দু দাঙ্গাবাজরা তার তিন মেয়েকে তুলে নিয়ে তাদের সম্ভ্রমহানি করবে। তিনি তার তিন মেয়েকে নিজ হাতে হত্যা করেন, যাতে তাদের সম্ভ্রম রক্ষা পায়। এ দৃশ্য দেখে ওই তিন বোনের ছোট্ট ভাই তার বোনদের রক্ত দিয়ে ঘরের দেয়ালে স্লোগান লিখেছিল- ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’।

ইউসুফ সাররাফ লিখেছেন, জম্মু, কাঠুয়া, উধমপুর ও রিয়াসি এলাকায় দুই লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে এবং ২৫ হাজারের বেশি মুসলমান নারীকে অপহরণ করা হয়। অপহৃত নারীদের হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হতো। যারা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করত, তাদের জীবিত ছেড়ে দেয়া হতো। আর যারা গ্রহণ করত না, তাদের হত্যা করা হতো। মুসলমান নারীদের বিভিন্ন কয়েদখানায় রাখা হতো। কিছু জায়গায় তাদের প্রিয়জনদের শরীরের গোশত রান্না করে তাদের দিয়ে বলা হতো, ‘ভাতের সাথে মানুষের ওই গোশত খাও।’

জম্মুতে সংঘটিত ওই হত্যাকাণ্ডের এক প্রত্যক্ষদর্শী আমানুল্লাহ খান ৩০ বছর পর্যন্ত ইসলামাবাদে আমেরিকার দূতাবাসে কাজ করেছেন। তিনি ‘টাইট রোপওয়াক’ নামে স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর কিভাবে জম্মুর মুসলমানদের পুলিশলাইনে জড়ো করা হয় এবং বহু লরিতে বসিয়ে শিয়ালকোটে পাঠানো হয়; এরপর পথিমধ্যে তরবারিধারী হিন্দুরা হামলা করে- তা তিনি ওই স্মৃতিকথায় লিখেছেন। একজন হিন্দু যখন আমান সাহেবের ওপর হামলা করতে উদ্যত হয় তখন তার মা বলেন, আমান পালিয়ে যাও। তিনি তার মাকে একা রেখে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। পরিশেষে মা তার পুত্রকে পাশের নদীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। নদীতে থাকা অপর এক নারী সাত বছর বয়সী আমানকে নদীর অপর কিনারায় নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে আমান তার মাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে রক্তস্নাত দেখতে পান। আমানকে নিজের জীবন রক্ষা করতে অন্যদের সাথে পালাতে হয়। এরপর তিনি তার মা ও চার বোনকে আর কখনো দেখেননি।

শ্রীনগরের কাশ্মির টাইমসের সম্পাদক বেদ বাসিনও জম্মুর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি কয়েকবার লিখেছেন, এ গণহত্যা মহারাজা হরি সিংয়ের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানেরা মিরপুর ও রাজৌরি এলাকায় হিন্দুদের হত্যা করে। জম্মু-কাশ্মিরের মুসলমান কালও জীবন দিয়েছে, আজো দিয়ে যাচ্ছে। কাল আরএসএস আর তাদের উর্দি পরা পৃষ্ঠপোষক মেরেছে, আর আজ আরএসএসের মতাদর্শীরা কাশ্মিরি মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। আমরা একে অপরের প্রতি এতটা ঘৃণা কেন করছি? ৬ নভেম্বর জম্মুর শহীদ দিবসে আমাদের কয়েকজন বড় রাজনীতিবিদ একে অপরের বিরুদ্ধে ভাষণে লিপ্ত থেকেছেন। ৬ নভেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে কারোই জম্মুর আতা মুহাম্মাদকে মনে পড়েনি, যার ছেলে তার বোনের রক্তে ঘরের দেয়ালে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লিখেছিল।

পাকিস্তানের জাতীয় উর্দু পত্রিকা দৈনিক জং ৮ নভেম্বর ২০১৮ থেকে ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement