২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় রাশিয়া

বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় রাশিয়া - ছবি : সংগ্রহ

 

বিশ্ব রাজনীতিতে বর্তমানে একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে সাবেক পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া দাপটের সাথে বিশ্বরঙ্গমঞ্চে এখন নতুন পরাশক্তি হয়ে উঠতে মরিয়া।

সিরিয়ার যুদ্ধে বলতে গেলে রাশিয়ার কূটকৌশল ও শক্তিমত্তারই জয় হচ্ছে। সিরিয়ার বিপর্যস্ত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও তার সরকারি বাহিনী রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দীর্ঘ কয়েক বছরের যুদ্ধের পর সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীরই জয় হচ্ছে। এর মূল কারণ বাশারবিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর প্রতি সমর্থনদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তহীনতা ও দুর্বল ভূমিকা এবং সরকারি বাহিনীর প্রতি সমর্থনদানকারী রাশিয়ার বিমান ও স্থলবাহিনীসহ সার্বিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সহায়তা প্রদান। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতেও রাশিয়ার আধিপত্যবাদী ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমেরিকায় ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ক্রমেই ম্লান হয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর বিভাজনের সুযোগ নিয়ে রাশিয়া নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্নে এখন বিভোর। এরই অংশ হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেনের ভূখণ্ডের অংশবিশেষ ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ইউক্রেনকে একটি স্বাভাবিক দেশ হিসেবে তার কর্মকাণ্ড চালানোর পথে বিশাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই মালয়েশিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান মর্মান্তিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, কিন্তু রাশিয়া এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা অস্বীকার করেছে। পশ্চিমা জোটের ছোট দেশগুলোকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রেও রাশিয়া বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইউক্রেন হচ্ছে এর জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১৬ সালে মন্টিনিগ্রোতে একটি অভ্যুত্থান প্রয়াসের মাধ্যমে এই ছোট্ট দেশটিকে ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে বাধা প্রদান করা হয়। অবশ্য ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই ষড়যন্ত্রের জন্য রুশ নাগরিকদের অভিযুক্ত করা হয়।

অতি সম্প্রতি রাশিয়া সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া লাটভিয়ার নির্বাচনেও রাশিয়াপন্থী একটি দলকে বিজয়ী করার জন্য নানা উপায়ে প্রভাব বিস্তার করে। এ ছাড়া, পশ্চিমা দেশগুলোর নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়ও রুশ প্রভাব ও হস্তক্ষেপ এখন একটি আলোচিত বিষয়। কিছু দিন আগে বসনিয়া হারজেগোভিনায় যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেও রুশ হস্তক্ষেপে মস্কোর মিত্র মিলোরাড ডোডিক যৌথ প্রেসিডেন্সিতে নির্বাচিত হয়ে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বলকানের এ দেশটি তাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিভাজন কাটিয়ে উঠে ন্যাটোতে যোগদানের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়ার হস্তক্ষেপে সেখানেও সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

আমরা জানি, আফগানিস্তান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। আফগানরা স্বাধীনচেতা জাতি। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ দেশটি বারবার বিদেশী ও আধিপত্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিতে আগ্রাসন চালালে সেখানে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূচনা হয় এবং একপর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে পরাজয় বরণ করে সেখান থেকে চলে যায়। এরপর সেখানে দেখি মার্কিন ও পশ্চিমাদের আগ্রাসন। দীর্ঘ দিনের যুদ্ধে সেখানে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্মান্তিক পরিণতি ও পরাজয় থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ না করে যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে আগ্রাসন চালায়। আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়েছে। দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল এই যুদ্ধে আমেরিকাও পরাজয়ের পথে। এখন আফগানিস্তানে তাদের অবস্থা হলো- ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

আমেরিকা ও ন্যাটোর সৈন্য এখনো আফগানিস্তানে মোতায়েন রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরেই ক্রমান্বয়ে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য (ন্যাটো ও আমেরিকার) প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই আবার আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। ট্রাম্পের প্রচেষ্টা মোটেই ফলদায়ক হয়নি, বরং দেশটিতে বিদেশী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা তালেবানদের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করতে বাধ্য হয়েছে।

সম্প্রতি বিশ্ববাসী বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছে, আফগান সঙ্কট নিরসনে আফগানিস্তানে প্রথম আগ্রাসন চালানো তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্তমান প্রতিনিধি রাশিয়া এগিয়ে এসেছে। গত শুক্রবার রাশিয়ায় আলোচনায় বসেছিল আফগানিস্তানের উচ্চপর্যায়ের শান্তি পরিষদের (এইচপিসি) প্রতিনিধি এবং তালেবান। কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে রাশিয়া দুই পক্ষকে এই আলোচনায় বসাতে সক্ষম হয়েছে। এই বৈঠকের আয়োজন করার মাধ্যমে রাশিয়া যে এ অঞ্চলে আবার প্রভাব বিস্তার করতে চায় তারই ইঙ্গিত দিলো।

রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভারভ। তিনি আফগান বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। আমরা জানি, প্রায় ৩০ বছর আগে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া বিতাড়িত হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই আফগানিস্তানে তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার এই নতুন উদ্যোগকে ইতিহাসবিদেরা ‘বড় খেলা’ বলে অভিহিত করেছেন। আফগানিস্তানে প্রায় চার দশকের চলমান যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত অন্য দেশগুলো যেখানে ব্যর্থ হয়েছে- সেখানে পরাজিত রাশিয়ার এই তৎপরতা সত্যিই তাদের নতুন খেলা ও ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এই বৈঠকে আফগানিস্তানের উচ্চপর্যায়ের শান্তি পরিষদের চারজন প্রতিনিধি, পাঁচজন তালেবান প্রতিনিধি, চীন, পাকিস্তান, ভারত, ইরানসহ ১১টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এতগুলো দেশকে এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করানো নিঃসন্দেহে রাশিয়ার কৃতিত্ব।

এ দিকে, আফগানিস্তানে গত ২০ অক্টোবর পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৪৯ আসনের পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষে প্রায় দুই হাজার ৫০০ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেখানে নারীদের জন্য ৬৮টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছে। দেশটিতে এক দিকে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অপর দিকে, তালেবানরা তাদের খুনখারাবিসহ সহিংস তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

আমরা আগেই বলেছি- বিশ্বে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া নতুন সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে উঠলে বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হবে। এখনো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও ন্যাটোর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কাছে রাশিয়া বড় কোনো শক্তি নয়। কিন্তু আমেরিকা ও পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে রাশিয়া আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাশিয়া ন্যাটোকে দুর্বল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে রাশিয়া আরো শক্তির প্রদর্শনী দেখাবে এবং নিজেকে একক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করবে। আমেরিকা ও ন্যাটোকে তাই এখনই রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন এবং সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement