২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ওয়ান টাইম ক্রেডিবল ইলেকশন

ওয়ান টাইম ক্রেডিবল ইলেকশন - ছবি : সংগ্রহ

সংসদ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, এক দশক ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা ১/১১-এর কুশীলবদের পুনরায় সক্রিয় হওয়ার যড়যন্ত্রের সাথে ‘বিএনপির যোগসূত্র’ তত্ত্ব সামনে নিয়ে এসে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির ঘটনা যা ‘১/১১’ নামে অভিহিত, সে সম্পর্কে কলামিস্ট, গবেষক ও জাসদের সাবেক নেতা মহিউদ্দিন আহমেদের তথ্যবহুল যে প্রবন্ধটি দৈনিক ‘প্রথম আলো’ ঈদুল ফিতর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে নেপথ্য কাহিনী জানতে পেরে দেশবাসী হতভম্ব। নবম সংসদ নির্বাচন ক্রেডিবল বা বিশ্বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির প্রস্তাবিত নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এর আগে ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সংবিধান লঙ্ঘন করে বঙ্গভবনে এক ধরনের অভিযান চালিয়েছেন।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ ও দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে এবং সংবিধানবহির্ভূতভাবে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে দুই বছরের জন্য প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগে বাধ্য করা হয়েছিল। এটাকেই দেশবাসী ‘১/১১’ নামে জানে। ওই ঘটনার ১১ বছর ছয় মাস পর মহিউদ্দিন আহমেদের লেখায় ১/১১-এর খলনায়ক জেনারেল মইনের ও তার সহযোগী ব্রিগেডিয়ার এ টি এম আমিন এবং চৌধুরী ফজলুল বারীর সাক্ষাৎকার, রাষ্ট্রদূতদের বক্তব্য ও বিএনপির চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তাদের কথোপকথন, জাতীয় পার্টি প্রধান হু. মু. এরশাদ ও রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্য স্থান পাওয়ায় ‘১/১১’ নাটকের মঞ্চের নেপথ্যের অনেক অজানা কাহিনী জানতে পেরে দেশবাসী বিস্মিত।

লেখাটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামরিক বাহিনী নির্বাচন বন্ধে হস্তক্ষেপ করবে বলে বেগম জিয়া ভাবতেও পারেননি। অপর পক্ষে, আওয়ামী লীগের সভাপতি রাষ্ট্রদূতদের কাছে বলেছিলেন ‘সামরিক বাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করে সবকিছু টিকঠাক করে দিতে পারে, তাহলে ভালো হবে।’ সামরিক বাহিনী যদি ক্ষমতা না ছাড়ে, এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মতে, সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন দৃঢ়চেতা কেউ নেই।’ তিনি জানার কথা, প্রভাবশালী ভারতের সমর্থন ছাড়া কোনো সামরিক সরকার এ দেশে টিকতে পারবে না। দেশটি যেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকে, তাই সামরিক জেনারেলদের কাছে আওয়ামী লীগ ফ্যাক্টর খুব গুরুত্ব পেয়েছে। উল্লেখ্য, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় ভারত বিএনপি সরকার ও সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জেনারেলের ওপর অসস্তুষ্ট ছিল বলে জানা যায়। ড. ইয়াজউদ্দিন সরকারের অধীনে ক্রেডিবল ইলেকশনে বড় যে তিনটি বাধা সে সম্পর্কে জেনারেল মইন ও আওয়ামী লীগ প্রধান অভিন্ন মত পোষণ করতেন। যেমন-

১. রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্বাধীন সরকার ‘নিরপেক্ষ নন’ বিধায় তার সরকারের অধীনে তিনি প্রভাব খাটিয়ে ‘বিএনপিকে পুনরায় ক্ষমতাসীন’ করবেন।

২. প্রধান নির্বাচন কমিশনারও নিরপেক্ষ নন। তাই এই কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন হলে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতাসীন হবে।

৩. ভোটার তালিকায় বহু ভুয়া ভোটারের নাম থাকায় ওই তালিকামাফিক নির্বাচন হলে বিএনপি জয়ী হবে।

ওই তিনটি বাধা অপসারণের জন্য তৎকালীন বিরোধী দলের ক্যাডাররা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও সহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের ও বিদেশীদের পক্ষ থেকে ওই বাধা অপসারণের জন্য ‘এক-এগারোর’ নায়কদের ওপর চাপ আসছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার মতো কোনো ডকুমেন্ট হাতে না থাকায় জেনারেল মইন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছিলেন না। ক্রেডিবল ইলেকশনের নামে নির্বাচন দুই বছর পেছাতে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন অপসারণপূর্বক নতুন সরকার ও নির্বাচন কমিশন কী উদ্দেশ্যে গঠন করতে হবে, তার নেপথ্য কারণ নাকি আওয়ামী লীগ প্রধান ছাড়া কেউ জানত না।

১৯৯৬ সালের মার্চে ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি কর্মচারীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতন ঘটানোর জের ধরে ২০০৬ সালে বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের উল্টাপাল্টা কাজে পুলিশ বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিরক্ত ছিল। সত্য কথা হলো, ড. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভোটকেন্দ্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এজেন্টরা সমান সুযোগ পাওয়ার কারণে ভুয়া ভোটারের নাম তালিকায় থাকলেও তাদের নামে ভোট দেয়া সম্ভব হতো না। তাই প্রশাসনের সহায়তায় বর্তমানের মতো নির্বাচনে প্রভাব খাটানো সেই সরকারের পক্ষে সম্ভব যে হবে না এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই জানত। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হলে ১৪ দলীয় মহাজোটের জয় অসম্ভব ছিল না। তবে ২০০ আসনে জয় নিশ্চিত ছিল না। আর ২০০ আসন না পেলে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। তা হলে ২০১২ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতা হয়তো হারাতে হতো। তাই নির্বাচন বন্ধ করে দুই বছর পেছানোর উদ্দেশ্যেই নির্বাচনে ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করে প্রত্যাহারের শেষ দিনে একযোগে ১৪ দলীয় প্রার্থীদের সব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়া হলো।

এভাবে নির্বাচনকে একতরফা দেখিয়ে তা বন্ধের জন্য দেশী-বিদেশী হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার পতনের পর দুই মাসের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচন হওয়ায় আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৫ ও জাপা ৩২, জামায়াত দুই, জাসদ (রব) এক ও অন্যরা তিনটি আসন পায়। এতে জাপা ও জাসদের (রব) সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হলেও ২০০ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় পাঁচ বছর কেটেছিল খুবই অস্বস্তিতে। ওই অভিজ্ঞতা থেকে ২০০৭-এর নির্বাচন দুই বছর পেছানোর দরকার ছিল বিধায় প্রয়োজনে সেনা হস্তক্ষেপের স্বার্থে, ক্রেডিবল ইলেকশন না হলে জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে কর্মরত ১৫-২০ হাজার সেনাসদস্যদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে- মর্মে জাতিসঙ্ঘের নামে একটি ভুয়া ই-মেইল বার্তা জেনারেল মইনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এতে বলীয়ান হয়ে মইন দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থ চিন্তা না করে সংবিধান লঙ্ঘন করে ১/১১ ঘটালেন। অথচ ওই সময় পর্যন্ত প্রায় ৭০-৭৫ লাখ বঙ্গসন্তান জমি জিরাত বিক্রি করে নিজ প্রচেষ্টায় বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বছরে এক লাখ কোটি টাকা রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতেন। এই রেমিট্যান্সের বদৌলতে আমাদের বিশাল অঙ্কের আমদানি ঘাটতি পূরণ হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছিল। আওয়ামী লীগ যেহেতু ‘১/১১’কে তাদের আন্দোলনের ফসল ঘোষণা করে, তাই ওই সরকারের প্রতি তাদের পরম মিত্র পড়শির কংগ্রেস সরকারের পূর্ণ সমর্থন ছিল বলে পরবর্তী ঘটনা প্রমাণিত করেছে। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর ওয়ান টাইম ক্রেডিবল ইলেকশনের নামে ১৪ দলকে ২৬৫ আসনে জয়ী করে কার্যত ক্রেডিবল ইলেকশনের সম্ভাবনা শেষ করে মইন বিদায় নেন।

জনগণের কাছে সবচেয়ে দুঃখের কারণ, ১/১১ সরকারের তৈরি করা ফটোযুক্ত ভোটার তালিকা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং পরবর্তী সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আর দরকার পড়ছে না। নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধান হবেন একটি দলের আজীবন সভাপতি এবং ১০ উপদেষ্টার স্থান দখল করেছেন ৩০০ এমপি। বিচারপতি আবদুল আজিজ কোনো নির্বাচন পরিচালনা না করেও ‘আজিজ মার্কা কমিশন’ হিসেবে উপাধি পেলেও ‘রকিব কমিশন’ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন এবং কারচুপিপূর্ণ অন্যান্য নির্বাচন করেও কথিত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য সরকারের শীর্ষমহলের ধন্যবাদ পেয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিটি করপোরেশন নির্বাচন ‘সফলভাবে’ করায় সরকারের ধন্যবাদ পাওয়ার পর জাতীয় নির্বাচনও অনুরূপভাবে সম্পন্ন করার কাজে এগিয়ে চলেছেন। ১/১১-এর আগের নির্বাচনে যেখানে সদ্য ক্ষমতা হারানো সরকারি দলের পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পাওয়া তা অসম্ভব ছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে সেখানে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচন যদি অন্তত ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো করার স্থায়ী ব্যবস্থা জেনারেল মইন করে দিতে পারতেন তাহলেই জনগণের মনে তিনি ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে থাকতেন। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীবর্গ ১/১১-এর কুশীলবদের ষড়যন্ত্র নিয়ে যতই উচ্চবাচ্য করুন না কেন দেশবাসী কিন্তু বুঝে গেছে ১/১১ এর লাটাই জেনারেল মইনের হাতে ছিল না। তার প্রমাণ ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব বাবুর লেখা বইতে রয়েছে। তদুপরি তা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে জাতিসঙ্ঘের দূত তারানকোর দূতিয়ালি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর দূতিয়ালির কাছে ব্যর্থ হওয়াই প্রমাণ করে। জনমনে বিশ্বাস, আগামী নির্বাচনেও ভারতের সমর্থন লাভ নিশ্চিত করার জন্যই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ও তাদের সহযোগী বারবার ভারত সফর এবং প্রতিউত্তরে গত ছয় মাসে প্রতিবেশী দেশে পররাষ্ট্র, অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাবেক রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরেই প্রমাণিত হয়। জেনারেল মইনের ১/১১-এর কারণেই ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা জনগণের হাত থেকে ক্ষমতাসীনদের হাতে চলে গেছে।

ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় বসাতে ১৭৩ দিন হরতাল পালন এবং সরকারি কর্মচারীদের ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করতে হয়েছিল। পুনরায় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসাতে জেনারেল মইনের নেতৃত্বে ‘১/১১’ ঘটিয়ে দুই বছর দেশবাসীকে অবৈধ সরকারের কঠোর শাসনে থাকতে হয়েছিল। মূলত ওই সরকারের ভুলের কারণে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ঘটেছে, যাতে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৫ জন নিহত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে জনগণকে ভোটাধিকার বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১/১১-এর কুশীলব ও সমর্থক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-জাপা সবার প্রতি জনগণের অনুরোধ, আগামী নির্বাচন অন্তত ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অথবা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো করার ঘোষণা দিয়ে জনমনের সন্দেহ দূর করুন।


আরো সংবাদ



premium cement