‘ভোট ডাকাতি ঠেকাতে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। এবারের রাজশাহী মেয়র নির্বাচনে যে ভোট ডাকাতির উদাহরণ সৃষ্টি হলো, তা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য লজ্জার। এটা ঠেকাতে না পারলে আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী মহানগরীর সম্ভাব্য সংসদ সদস্যপ্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুকেও মাঠে এসে প্রতিবাদ জানাতে হবে। তবে কাজের কাজ কিছুই হবে না।’ এখন প্রশ্ন হলো, এমন ভোট ডাকাতি ঠেকাবে কে এবং কিভাবে?
গত ৩০ জুলাই রাজশাহী মহানগরীর গণতন্ত্রপ্রিয় বাসিন্দাদের (আওয়ামী লীগ সমর্থক বাদে) জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের দিন। মূলত এদিন ক্ষমতাসীন দলীয় সমর্থকেরা প্রায় নির্দ্বিধায় হাসতে হাসতে অকেজো করে ফেলল গণতন্ত্রকে। এতে বিপন্ন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও। গাজীপুর ও খুলনার ভোট জালিয়াতির পর আশা করা গিয়েছিল নির্বাচন কমিশন কিছুটা হলেও সতর্ক হবেন। সেটা কিন্তু হলো না। ‘দুই কান কাটা’ ব্যক্তির মতো ঘোষণা দিয়ে দেয়া হলো, রাজশাহীতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে; অথচ তিন সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের মধ্যে রাজশাহীর নির্বাচনকে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ‘সবচেয়ে ভয়াবহ’ বলে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। কতটা ভয়াবহ ছিল চোখে না দেখলে এবং শুধু লেখার মাধ্যমে বোঝানো অসম্ভব।
৩০ জুলাই সকাল ৭টার মধ্যে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা প্রতিটি ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে নেন। আমার নিজের ১৩টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। কোনো ভোটকেন্দ্রেই একজন বিএনপি নেতাকর্মীও নজরে পড়েনি। অথচ খোঁজ নিয়ে জেনেছি, প্রতিটি ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র তৈরির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সেই পরিচয়পত্র বিএনপি নেতাকর্মীরা কেন পেলেন না তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানামুখী বিশ্লেষণ। অবশ্য প্রবীণ ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে এর জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের অসহায়ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রকাশ্যে বলে ফেলেছেন, এই নেতাকর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন তুলছেন, বিএনপি নেতাদের ঐক্য কি ছিল শুধুই লোক দেখানো?
অসহায় সৈনিকের মতো, নিজের ভোট না দিয়ে ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়ে একাই লড়াই করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও সদ্য বিগত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তবে সেখানেও প্রত্যাশিত সমর্থন পাননি বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে। অথচ বিস্মকর হলেও সত্য, ৩০ জুলাইয়ের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে অদম্য উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছিলাম। ৩০ জুলাই সেটা যেন কর্পুরের মতো উড়ে গেল। এই রকম রহস্যময় ঘটনা এর আগে রাজশাহী মহানগরীর কোনো নির্বাচনে আমরা দেখিনি। তারও কারণ রয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপি নেতাকর্মীরা ধারাবাহিকভাবে পুলিশের গ্রেফতারের মুখে পড়ে। প্রতিদিনই ঘটতে থাকে গ্রেফতারের ঘটনা। নেতাকর্মীরা সর্বক্ষণ ভীত ছিলেন পুলিশের অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে। সবাই ধরে নিয়েছিলেন- আমরা যতই চেষ্টা করি আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী খাইরুজ্জামান লিটনই শেষাবধি জয়লাভ করবেন। সুতরাং চেষ্টা করে লাভ নেই; কিন্তু এভাবে ভোট ডাকাতিতে সরকারদলীয় কর্মীরা নেমে যাবেন সেটাই ছিল সবার কাছে অভাবনীয়।
ভোটকেন্দ্রে কোনো সংবাদকর্মীর প্রবেশাধিকার ছিল না। ভোটারেরা মোবাইল নিয়ে ভোটকেন্দ্র্রে গেলে পুলিশ বাধা দিলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেলায় তা ছিল অবারিত। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র দখলে রাখার জন্য যা যা দরকার, তার সবই করেছে ক্ষমতাসীন দলীয় কর্মীরা। জানা যায়, আওয়ামী লীগপন্থী কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা তাদের পোলিং এজেন্টদের কেবল নিজেদের ভোট সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দেননি; পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন- কেউ যদি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সমর্থনে জাল ভোট দেয় তাহলে যেন বাধা না দেন; কিন্তু মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের বেলায় অবশ্যই বাধা দিতে হবে। অবশ্য তাদের সেরকম বাধা দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ বিএনপি নেতাকর্মীরা সেদিন মাঠেই ছিলেন না। ভোট জালিয়াতির খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে আসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বেলা ২টায়ই ভোটকেন্দ্র প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়। কারণ বুলবুল সমর্থকেরা ধরে নিয়েছিলেন ভোট দিলে, ফলাফলের কোনো পরিবর্তন হবে না। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় পুলিশের হুমকি-ধমকি ছিল বহুল আলোচিত।
পরাজিত মেয়র প্রার্থী বুলবুল এ ব্যাপারে অভিযোগ করলেও নির্বাচন কমিশন আসলে এটাক আমলে নেননি। বরঞ্চ আমরা দেখলাম, এই অন্যায় গ্রেফতারের পক্ষে পুলিশ যে যুক্তি দিয়েছে, সেটাই নির্বাচন কমিশন মেনে নিলো। তখনই মহানগরবাসীর বুঝতে বাকি থাকল না, প্রশাসনই প্রার্থীদের জয় পরাজয়ের এক ধরনের দায়িত্ব নিয়েছে। এটা কেবল আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থীর বেলায় ঘটেনি। কাউন্সিলরাও এই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেলেন। অথচ রাজশাহী মহানগরীর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বারবার বলে এসেছিলেন, তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন মেয়রের বেলায়। কাউন্সিলরদের নিজের যোগ্যতা বলে জয়লাভ করে আসতে হবে; কিন্তু কাউন্সিলরদের নির্বাচনী প্রচারণার সময় পুলিশ যেভাবে ‘সহযোগিতা’ করেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যে এর তেমন কোনো সত্যতা মেলে না। নিজেই বেশ কয়েকটা ওয়ার্ড ঘুরে জানতে পেরেছি, যেসব কাউন্সিলর মেয়র নির্বাচনে ব্যাপকভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন, তারাই পেয়েছে প্রশাসনের সহযোগিতা।
ভোটকেন্দ্রে বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট থাকতে পারেননি। বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি ইসলামিয়া কলেজ ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্টকে ঢুকাতে হয়েছে মেয়রপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের সহযোগিতায়। ভোটকেন্দ্রে বুলবুল প্রবেশ করলে আওয়ামী লীগের সব কর্মী বিক্ষোভ করতে থাকেন। এই ভোটকেন্দ্রে মেয়র পদের ৬০০ ব্যালট পেপার পাওয়া যায়নি। রিটার্নিং অফিসারকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেও কোনো যথাযথ উত্তর মেলেনি। আর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা ভোটারেরা ভোট দিতে না পেরে একযোগে বিক্ষোভ করেছেন। এই অভূতপূর্ব বিক্ষোভের ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এতসব অনিয়মের মধ্যে ভোট হলেও নির্বাচন কমিশন সেদিকে নজর দেননি। আসলে নজর দেয়ার কোনো মানসিকতা তাদের ছিল না। মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ‘বড় ব্যবধানে হারবেন’ সে ভবিষ্যদ্বাণী করেই ফেলেছিলেন স্বয়ং খাইরুজ্জামান লিটন।
সে কারণেই হয়তো এটা জেনে একরকম নির্ভর হয়েই প্রচারণা চালিয়েছিলেন। একপর্যায়ে বুলবুলকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন ‘রায়’ মেনে নেয়ার জন্য। আর তখনই বলতে গেলে, রাজশাহী মহানগরীরবাসীর ভোট দেয়ার উৎসাহ হারিয়ে যায়। ধরে নেয়া হয়েছিল অন্তত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা মহিলা ভোটারদের ভোটদানের বিষয়ে অনুপ্রেরণা জোগাবেন। তারা সেটাও করেননি। কারণ তাদের অনেকে আগেই জেনে গিয়েছিলেন, প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় তাদের ‘জয়’ অবধারিত। লক্ষণীয় এবার কোনো জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী কাউন্সিলর (সংরক্ষিত আসনে একজন মহিলা প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন) নির্বাচিত হতে পারেননি। আর বিএনপি সমর্থিত চারজন নির্বাচিত হলেও তারা এখন পূর্ণাঙ্গ বিএনপিপন্থী নন। তাদেরও আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের প্রতিরোধ করার সাধ্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ছিল না।
আর সেই সুযোগই নিয়েছে সরকারি দল। কোনো কোনো পত্রিকা লিখেছে, খাইরুজ্জামান লিটনের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। কথাটা একেবারে অসত্য নয়। তবে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যদি এবার লিটন নির্বাচিত না হন তাহলে কি নগরীর উন্নয়ন বন্ধ থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দিতে পারেননি। আসলে কর্তৃত্ববাদীদের নিয়ন্ত্রিত শাসনের চাপে জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ভোট ডাকাতি ঠেকাতে কোনো সমন্বিত প্রচেষ্টাই চালাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন নেতাকর্মী গ্রেফতার হলেই অন্যরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা দূরের কথা- তারা যেন ভয়ে গর্তে লুকিয়ে যাচ্ছেন। মেয়রপ্রার্থী বুলবুল শুধু একাই প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা পৃথকভাবে কোনো এলাকায় বুলবুলের পক্ষে ভোট চেয়ে সভা করতে সাহসী হননি। অথচ বিগত নির্বাচনে বিএনপি নেতাকর্মীদের তৎপরতার চমৎকার সমন্বয় ছিল। এমনকি মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে জবরদস্ত কমিটি ছিল। এবার তার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া গেল না। কে যে তাদের মুখপাত্র, রাজশাহী মহানগরবাসী জানতেই পারেননি। একজন তরুণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই বিষয়ে বললেন, ‘ভোট ডাকাতি ঠেকাতে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়।
এবারের রাজশাহী মেয়র নির্বাচনে যে ভোট ডাকাতির উদাহরণ সৃষ্টি হলো, তা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য লজ্জার। এটা ঠেকাতে না পারলে আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী মহানগরীর সম্ভাব্য সংসদ সদস্যপ্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুকেও মাঠে এসে প্রতিবাদ জানাতে হবে। তবে কাজের কাজ কিছুই হবে না।’ এখন প্রশ্ন হলো, এমন ভোট ডাকাতি ঠেকাবে কে এবং কিভাবে?
লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, রাজশাহী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা