২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্রিটেনের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোট গ্রহণ

ভোট দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও লেবার পার্টি প্রধান জেরেমি করবিন হইন্টারনেট -

ব্রিটেনে ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে গতকাল ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় থ৬৫০টি আসনে শুরু হয় ভোট গ্রহণ, বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। বরিস জনসনের নেতৃত্বে ব্রেক্সিট, নাকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত উল্টে দেয়ার মতো আরেকটি গণভোটÑ এই দুইয়ের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিতে পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচনের ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রিটেনের নাগরিকরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এমন নির্বাচনের মুখোমুখি আর হয়নি। কেননা এই সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বৃহস্পতিবার গ্রিনিচ মান সময় ৭টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা ১টা) ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৬৫০টি আসনে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। রাত ১০টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের পরই শুরু হয় গণনা। আজ শুক্রবার সকালে প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অধিকাংশ আসনের ফল ঘোষণা করার কথা রয়েছে। ব্রিটেনে এই ভোট ২০২২ সালে হওয়ার কথা থাকলেও মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট) নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটেই আবারও ভোট হচ্ছে।
ব্রেক্সিট নিয়ে পরিস্থিতি এতটাই জটিল অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙে ডিসেম্বরে ভোটের আয়োজন করতে হয়েছে কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। পার্লামেন্টে তিনবার ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে ব্যর্থ হয়ে থেরেসা মের পদত্যাগের পর ক্ষমতায় আসা জনসনকেও কম গলদঘর্ম হতে হয়নি। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিটে ব্যর্থ হয়ে তাই তাকে ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হয়েছে।
জনসনের ভাষায়, ব্রিটেনের বিদায় (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে) এবং অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে এই নির্বাচন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যেতে কোনো একটি দলের কমপক্ষে ৩২৬টি আসন জিথততে হ বে। ‘ব্রেক্সিট সম্পন্ন কর’ (গেট ব্রেক্সিট ডান) সেø­াগানে এই নির্বাচনে অংশ নেয়া জনসনের জয়ের ব্যাপারে আভাস মিলেছে বেশ কয়েকটি মতামত জরিপে। বুধবার ব্রিটেনের কয়েকটি ভোট জরিপকারী সংস্থা তাদের মতামত জরিপের ফল ঘোষণা করেছে। এসব জরিপের সব ক’টিতেই দেখা গেছে, বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টির জনসমর্থন গতবারের চেয়ে কিছুটা কমলেও এখনো লেবার পার্টি চেয়ে এগিয়ে। অন্তত সাতটি জরিপের ছয়টিতে দেখা গেছে, কনজারভেটিভদের প্রতি জনসমর্থন কমলেও লেবারদের চেয়ে বেশি। অন্য দিকে তিনটি সংস্থার জরিপে লেবার পার্টির প্রতি জনসমর্থন গতবারের চেয়ে কিছুটা বাড়ার চিত্র এসেছে। তবে এসব জনমত জরিপ কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের ইতিহাসে এসব জনমত জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সঠিক হয়েছে, কখনো ভুলও হয়েছে। নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবধান কমে আসার ফলে কনজারভেটিভ পার্টি সবচেয়ে বেশি আসনে জিতলেও সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার সম্ভাবনা এখন আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।
জয়লাভ করলে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাজ্যকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসবেন এমন প্রতিশ্রুতি জনসন দিচ্ছেন। পাশাপাশি ক্ষমতায় টিকে যেতে পারলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পুলিশের মানোন্নয়নে আরো বেশি অর্থ ব্যয়ের আশাও দেখিয়েছেন। অন্য দিকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ক্ষমতায় এলে ছয় মাসের মধ্যে নমনীয় একটি ব্রেক্সিট চুক্তি করতে গণভোটে দেয়া ছাড়াও নাগরিকদের জন্য আরো বেশি ব্যয়, প্রধান সেবাগুলো জাতীয়করণ এবং ধনীদের ওপর আরো বেশি করারোপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের মাঠে নেমেছেন।
এই নির্বাচনে জয় বরিস জনসনকে হয়তো আবারো দেশটিকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু আদতে ব্রেক্সিট এখনো অনেক দূরের পথ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ ইইউর সাথে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি যে ১১ মাস সময় নিয়েছেন, সেটি করতে তাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। ৩১ জানুয়ারির পরই আসলে একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে ব্রিটেন। ওই সময়ই ইইউ২৭ এর সাথে নতুন সম্পর্কের বিষয় নিয়ে দেশটি এগোতে পারে, আর জনসন ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এই কাজটিই করার প্রতিশ্রতি দিয়েছেন।
ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ২০১৬ সালের গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় দেয়। তার আগের কয়েক দশক ধরে ব্রিটেন এবং ইইউর অর্থনীতি এবং বাণিজ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল। তাই গণভোটের পরই কথা ওঠে যে ইইউ ত্যাগ করার ফলে যাতে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো ক্ষতি না হয়, দুই অংশের জনগণ চাকরিবাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা ভোগ করতেন সেগুলোতে কোনো ছেদ যেন না পড়ে Ñ তাই ব্রেক্সিট কিভাবে হবে তা আগে থেকেই একটা চুক্তির ভিত্তিতে স্থির করে নিতে হবে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং পূর্বসূরি থেরেসা মে এরকম চুক্তি করে এসেছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে। তবে তারা তাদের প্রস্তাবিত চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারেননি। পার্লামেন্টে ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন তিক্ততা, বিভক্তি ও অচলাবস্থার ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সঙ্কট নিরসনের স্বার্থেই নতুন এই নির্বাচন দেয়া হয়েছেÑ যাতে কোনো একটি দল সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসে ব্যাপারটাকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে। এ জন্যই বলা হচ্ছে, ব্রেক্সিট হবে কি না বা কিভাবে হবে তা নির্ধারিত হবে এ নির্বাচনে।
ব্রেক্সিটপন্থীরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে এলে সেখানকার সমাজ ও অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। বিপরীতে ব্রেক্সিটবিরোধীদের দাবি, এর পরিণতিতে ব্রিটেন ভেঙে যেতে পারেÑ কারণ স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে জোর জনমত আছে। অন্য দিকে ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়া পড়বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপরওÑ অনেকের মতে ইইউর ঐক্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এক কথায় গোটা ইউরোপেই অনেক সুদূর প্রসারী পরিবর্তন আসতে পারে। আর এ নির্বাচনের পরিণতিতে ব্রেক্সিট যদি না হয়Ñ তাহলে অনেকের মতে ব্রিটেনে এক গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেবে। জনগণের একাংশের মধ্যে গুরুতর বিভক্তি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি সৃষ্টি হবে জনগণের গভীর অনাস্থা। অনেকে সামাজিক সঙ্ঘাতের আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন।


আরো সংবাদ



premium cement