২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোর হাল ছাত্রদল নেতৃত্বহীন অন্যগুলো জরাগ্রস্ত

-

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দল গোছানোর উদ্যোগ নেয় বিএনপি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সংগঠন ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে অর্ধশতাধিক সাংগঠনিক জেলা শাখা এবং কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন করা হলেও সে প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি। এখনো বেশ কয়েকটি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। বিএনপির অঙ্গসংগঠন ১১টি। এর মধ্যে নতুন কমিটি বা পুনর্গঠন করা হয়েছে পাঁচটির। সম্প্রতি ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলের লক্ষ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল করা হয়েছে। নতুন কমিটি গঠন নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। ফলে সংগঠনটি এখন নেতৃত্বহীন। আর বাকি সংগঠনগুলোও নানা কারণে জরাগ্রস্ত। বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোর দিকে তাকালে দলটির সাংগঠনিক ভঙ্গুর অবস্থার চিত্রই ফুটে ওঠে। অবশ্য বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার দাবি ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর দল গোছানোর উদ্যোগ নানা কারণে সম্পন্ন হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি দেয়া হলেও তা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের আংশিক নতুন কমিটি হয়েছে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার উপক্রম হলেও এসব কমিটির কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলো হলো জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল, ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল এবং মৎস্যজীবী দল।
ছাত্রদল : ছাত্রদলকে বলা হয় বিএনপির প্রবেশদ্বার। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করে। পরবর্তীপর্যায়ে তারা অন্যান্য অঙ্গসংগঠন বা বিএনপির মূল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। কিন্তু দুই বছর মেয়াদি কমিটির বয়স পাঁচ বছর হলেও নতুন কমিটি গঠন হয়নি। ফলে প্রায় মুখথুবড়ে পড়েছে সংগঠনের কার্যক্রম। এরই মধ্যে গত ৩ জুন ঈদের আগের দিন রাতে ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করা হয়। বয়সসীমা নির্ধারণসহ বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয়ায় বাতিল হওয়া কমিটির নেতারা আন্দোলন করছেন। তারা বয়সসীমা তুলে দিয়ে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি করেছেন। নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালিত হয়। ছাত্রদলের বাতিল হওয়া কমিটির সহসভাপতি এজমল হোসেন পাইলট ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী এতে অংশ নেয়। বিক্ষুব্ধরা ‘সিন্ডেকেট দালালরা হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘ঘাপটি মারা দালালদের কালো হাত, গুঁড়িয়ে দাও ভেঙে দাও’, ‘আমাদের সংগ্রাম, আমাদের ত্যাগ বৃথা যেতে দেবো না’, ‘খালেদা জিয়া যখন জেলে গেল, সিন্ডিকেট কোথায় ছিল’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে সরব করে রাখেন। আসাদুজ্জামান আসাদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আমাদের দাবির সমর্থনে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করছি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।
আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। কাউন্সিলে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ২০০০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতার শর্তারোপ করা হয়। প্রতিবাদে গত ১০ জুন ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধরা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অসুস্থ রুহুল কবির রিজভীকেও তারা অবরুদ্ধ করে রাখে। ওই দিন সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বিক্ষুব্ধদের গুলশান কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে কথা বলেন। পরে রাত ১০টায় বিক্ষুব্ধরা নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা খুলে দেয়। এরপর গত রোববার থেকে বিক্ষুব্ধরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন দুই ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেয়। গতকালও বিএনপির কার্যালয়ের সামনে তারা বিক্ষোভ করেন। কার্যালয়ে প্রবেশের সময়ে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম ও যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকেও বিক্ষুব্ধরা ঘিরে ধরে তাদের দাবির কথা জানায়।
পরে ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতা ইখতিয়ার রহমান কবির নয়া দিগন্তকে জানান, তারা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের সাথে কথা বলেছেন। খোকন বিক্ষুব্ধ ছাত্রনেতাদের আশ্বস্ত করেন যে, আজ মঙ্গলবারের মধ্যে ছাত্রদলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। সে জন্য তারা অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেছেন। দাবি পূরণ না হলে আবারো কাল বুধবার থেকে তাদের আন্দোলন শুরু হবে।
আড়াই বছরেও অপূর্ণাঙ্গ যুবদল : বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়তাবাদী যুবদল। কিন্তু দায়িত্বশীল নেতারা আড়াই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেননি। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি যুবদলের কেন্দ্রীয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও মহানগর দক্ষিণের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ থাকলেও তা হয়নি। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন।
সাত নেতা দিয়েই চলছে স্বেচ্ছাসেবক দল : ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশক্রমে শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি এবং আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাত সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি অনুমোদন দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি করা হয়। নির্দেশনা ছিল এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের; কিন্তু দীর্ঘ আড়াই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্তমান নেতারা।
তিন বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ শ্রমিক দল জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ২০১৪ সালের ১৯ ও ২০ এপ্রিল দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের তিন দিন পর আনোয়ার হোসাইনকে সভাপতি, নূরুল ইসলাম খান নাসিমকে সাধারণ সম্পাদক ও জাকির হোসেনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রায় তিন বছর ধরে শ্রমিক দলের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গ্রুপিং ও কোন্দল বেড়েছে। বিএনপির দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান ছাড়া দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
জাসাস : ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ৩০ সদস্যবিশিষ্ট জাসাসের নতুন আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমান কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মামুন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খান। এই কমিটি গঠনের পর বিক্ষোভ শুরু হয়। বিএনপির আন্দোলনে জাসাস এক সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকত। সেই জাসাস এখন একেবারেই নীরব। নেতাকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ ও গ্রুপিং চলছে। কার্যক্রম সীমিত। তবে বর্তমান কমিটির নেতারা বিভিন্ন জেলায় নতুন করে কমিটি দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা দল : গ্রুপিং ও কোন্দলে অকেজো হয়ে পড়েছে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল। এ সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে নানামুখী মেরুকরণ চলছে। একটি অংশ দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাৎকে মেনে চলছে। অন্য অংশ দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের অনুসারী। এই কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।
প্রসঙ্গত চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপিপন্থী পেশাজীবী সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংগঠন গোছানোর প্রক্রিয়া শুরু করে বিএনপি। তারপর আট বছর পর ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দল, বাইশ বছর পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৫৩ সদস্যবিশিষ্ট কৃষকদল, ৩ এপ্রিল মহিলা দলের ২৬৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হয়। ৫ এপ্রিল ওলামা দলের ১৭১ সদস্যবিশিষ্ট এবং এক যুগের বেশি সময় পর গত ৬ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের ১২৮ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement