২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চিনিকলগুলোর লোকসান কমাতে উৎপাদন করা হবে অন্য খাদ্যও

তিন মাস কাজ করে সারা বছরের মজুরি নেন শ্রমিকেরা
-

নাম বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) হলেও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটি চিনি ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য নিয়ে কাজ করে না। চিনি উৎপাদন ও বিপণনের যে কাজটি তারা করে সেখানেও লাভের মুখ দেখছে না যুগ যুগ ধরে। বেসরকারি খাতের চিনিকলগুলো যেখানে রাতারাতি উন্নতি করছে সেখানে সুগার করপোরেশনের অধীন সরকারি মালিকানাধীন ১৫টি চিনিকল প্রতি বছর লোকসান দিচ্ছে গড়ে ২০০ কোটি টাকা করে। এর প্রধান কারণ সরকারি চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করেন বছরে তিন মাস। বাকি ৯ মাস কাজ না করেই বেতন নেন তারা। দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা এমন অযৌক্তিক নিয়ম ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। চিনিকলগুলোর লোকসান কমাতে এখন থেকে চিনির পাশাপাশি অন্য খাদ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের কাজটিও করবে বিএসএফআইসি।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন যে চিনি ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য উৎপাদন করে না তার উল্লেখ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট থেকে। নিজের কার্যাবলি সম্পর্কে বিএসএফআইসি লিখেছে, উন্নত প্রযুক্তিতে আখচাষ বৃদ্ধি করে মিলজোন এলাকায় আখের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ। মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতানুযায়ী ১০ লাখ মেট্রিক টন আখ মিলে সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। দক্ষতার সাথে মিলে নিরবচ্ছিন্ন আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন নিশ্চিতকরণ। উৎপাদিত চিনি দেশব্যাপী বিপণনের মাধ্যমে চিনির বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে চিনি, চিনিজাত ও উপজাতভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের শিল্প স্থাপন।
১৯৩০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সরকারি চিনিকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা অস্বাভাবিক নি¤œপর্যায়ে নেমে এসেছে। বেসরকারি খাতে সিটি গ্রুপের একটি চিনিকল যেখানে বছরে ১৫ লাখ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করছে, সেখানে সরকারি ১৫টি চিনিকল মিলে উৎপাদন করছে তার ৩০ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু আয়তন ও বার্ষিক ব্যয়ের দিক থেকে বেসরকারি যেকোনো চিনিকলের চেয়ে সরকারিগুলো অনেক এগিয়ে। দেশে সরকারি মালিকাধীন চিনিকলগুলো হলো জিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেড, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লিমিটেড, শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড, পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড, নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর সুগার মিলস লিমিটেড, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড, জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড, ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড, রাজশাহী সুগার মিলস লিমিটেড ও কেরু অ্যান্ড কোং সুগার মিল।
বিশ্লেষকদের মতে, চিনিকলগুলো যে যুগ যুগ ধরে কেবল লোকসানেরই মুখ দেখছে তার প্রধান কারণ এসব চিনিকল বছরে চলে মাত্র তিন মাস। আখের সরবরাহ না থাকায় বছরের বাকি সময় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অলস বসে থাকেন। এতে তাদের বেতনভাতায় সরকারি অর্থের একটি বড় অংশ অপচয় হয়। চিনিকলগুলোর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে খুব সহজেই লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতো বলে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ দিন ধরে মতামত দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার সে দিকে কর্ণপাত না করায় এসব চিনিকল দীর্ঘ দিন ধরে লোকসানে চলছে। প্রতি বছর মাথা ভারী হচ্ছে ঋণের বোঝায়। অথচ বেসরকারি চিনিকলগুলোর চিত্র আলাদা। সারা বছর চালু থাকার কারণে ব্যাপক লাভে আছে সেগুলো।
এমনই একটি প্রেক্ষাপটে বেসরকারিখাতের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেন, এ শিল্প লাভজনক করতে চিনিকলে শুধু চিনি করলেই চলবে না, অন্যান্য খাদ্যপণ্যও উৎপাদন করতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ ও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দেন। তবে প্রাথমিকভাবে কোনো ধরনের খাদ্যপণ্য দিয়ে উৎপাদন শুরু করা হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় গতকাল এ নির্দেশ দেন তিনি।
সভায় জানানো হয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১০টি নতুন প্রকল্পসহ মোট ৫২টি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে ৪৭টি বিনিয়োগ প্রকল্প, ৪টি কারিগরি ও ১টি নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্প রয়েছে। সব মিলিয়ে এসব প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ১ হাজার ৬৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে জিওবি খাতে ৯৩৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, প্রকল্প সাহায্য খাতে ৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন খাতে ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সভায় প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। এ সময় প্রকল্প সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সাথে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন তদারকি এবং অগ্রগতির চিত্র গণমাধ্যমে প্রচারের তাগিদ দেয়া হয়।
চিনি শিল্পকে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প উল্লেখ করে শিল্পমন্ত্রী বলেন, কৃষিভিত্তিক এ শিল্পকে লাভজনক করতে চিনিকলের উপজাত (বাই-প্রোডাক্ট) ব্যবহার করে নতুন পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। চিনিকলগুলোতে বিদ্যমান কাঁচামাল ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদনের প্রয়াস জোরদার করতে হবে। তিনি ছোট ও নি¤œমানের প্রকল্প না নিয়ে বৃহৎ আকারে কার্যকর প্রকল্প গ্রহণের পরামর্শ দেন। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ঘন ঘন খুচরা যন্ত্রাংশ বদলানোর প্রয়োজন হবে, সেগুলো পরিহার করে গুণগতমানের প্রকল্প গ্রহণ এবং দক্ষতার সাথে ওই সব প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।
হুমায়ূন বলেন, সরকারের ইশতেহার বাস্তবায়ন শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যতম দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে টিম স্প্রিটের সাথে সবাইকে কাজ করতে হবে। তিনি আসন্ন ঈদুল আজহার আগেই চামড়া শিল্পনগরীর কাজ সমাপ্ত করার তাগিদ দেন। ঈদের সময় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সে লক্ষ্যে এখন থেকেই সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে কাজ করার জন্য তিনি চামড়া শিল্পনগীর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন।


আরো সংবাদ



premium cement