২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে বঞ্চিত শিক্ষকেরা

শিক্ষায় বৈষম্য-৬
-

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অভিযোগ সীমিত কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে তাদের কিছু দেয়া হয় না। সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন দেয় কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে সরকারও কিছু পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় ভাগবাটোয়ারা, কুক্ষিগতকরণসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরামের সহসভাপতি সহকারী অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলেন, বেসরকারি স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের বেতনসহ বিভিন্ন খাত থেকে যে অর্থ আয় হয় তা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পায় না। পায় না সরকারও। হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের ছিটেফোঁটা কিছু দেয়। এ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে যারা যুক্ত তারা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে এর সাথে যুক্ত আছে কিছু শিক্ষক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, সেশন চার্জ, ভর্তি, পরীক্ষার ফিসহ বিভিন্ন খাত থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি অনিয়ম চলছে। টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য নানা ধরনের অপকর্মের আশ্রয় নেয় অনেক প্রতিষ্ঠান। লুটপাটকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠানে চলছে দলাদলি, আর কোন্দল। এ কথা জানে অন্য সব শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের চোখের সামনে এসব দুর্নীতি অনিয়ম আর লুটপাট চলছে। কেউ এর কোনো প্রতিবাদ করলে তাদের চাকরি থাকবে না। চোখের সামনে ঘটা এসব দুর্নীতির কারণে শিক্ষকদের মনে সব সময় অশান্তি, ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করে। এক দিকে শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে বঞ্চিত আরেক দিকে তাদের সামনে চলে লুটপাট। এতে তাদের মনে যে অশান্তি সব সময় বিরাজ করে তার ফলে ব্যাহত হয় শিক্ষার মান।
হারুনুর রশিদ বলেন, জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বেতনসহ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আয় সরকার যদি তার কোষাগারে নিতে পারত তাহলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে টাকা-পয়সা নিয়ে যে দুর্নীতি আর নৈরাজ্য চলছে তা পুরোপুরি দূর হয়ে যেত। একই সাথে বন্ধ হবে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি। শিক্ষকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারত। বাড়ত শিক্ষার মান। লাভবান হতো অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা।
তিনি বলেন, বেরসরকরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরকার কিছুই পাচ্ছে না। একতরফাভাবে শুধু দিয়ে যাচ্ছে। অথচ জাতীয়করণ হলে এভাবে টাকা ঢালা লাগত না সরকারের এ খাতে। সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারলে এর মাধ্যমে লাভবান হতো সরকার। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া অর্থাৎ জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব অশান্তির মূলে রয়েছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া এ বিপুল পরিমাণ টাকা।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের লুটপাট বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়ে হারুনুর রশিদ বলেনÑ কুমিল্লার বুড়িচং এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ শিক্ষকদের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে পরিচালনা পর্ষদকে টাকা দিতে বলে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে। এতে তিনি রাজি না হলে তার চাকরি চলে যায়।
হারুনুর রশিদ বলেন এ ধরনের অনেক অভিযোগ আছে আমাদের কাছে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ এবং বৈষম্য বঞ্চনার অবসান দাবি জানিয়ে হারুনুর রশিদ বলেন, আমরা সারা দেশে দুই কোটি ৩৫ লাখ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করছি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ৯৭ ভাগ বেসরকারি খাতে। তারপরও সব লাঞ্ছনা বঞ্চনা সইতে হয় আমাদের।
বেসরকারি কলেজের অনেক শিক্ষক জানান, প্রতিষ্ঠানের আয় কমিটি আর অনেক ক্ষেত্রে কমিটি ও প্রতিষ্ঠান প্রধান মিলে আত্মসাৎ করছে। বেসরকারি স্কুল কলেজের যত শিক্ষকদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে তাদের সবার প্রায় একই বক্তব্য।
বেসরকারি স্কুল কলেজ জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় বলা হয়েছে কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত জনবলকাঠামোর অতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিলে তাদের বেতন-ভাতাদি ও আনুষঙ্গিক সুবিধার শতভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।
এ ক্ষেত্রেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি নানাভাবে বঞ্চিত করে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে রাখে শিক্ষক-কর্মচারীদের এবং তাদের নাম মাত্র বেতন দেয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ রয়েছে যারা অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত শিক্ষকদের কোনো নিয়োগপত্রও দেয় না। মৌখিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষকদের যখন খুশি মৌখিক নির্দেশের মাধ্যমে বরখাস্ত করে দেন।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অনেকে জানান, সরকার তাদের যে পরিমাণ বেতনভাতা দেয় তার বাইরে তাদের আরো যেসব ন্যায্যপ্রাপ্তি তা প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়ার কথা। যেমন সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া দেয় মাত্র এক হাজার টাকা। কিন্তু সরকারি কলেজের একজন প্রভাষক বাড়িভাড়া পান বেতনের ৪০ ভাগ। এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান বেতনের ২৫ শতাংশ মাত্র। শিক্ষকেরা জানান, সরকারিভাবে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে ঘাটতি রয়েছে তা প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়ার কথা। তবে ২০১৮ সালে জারি করা বেসরকারি স্কুল কলেজ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।
সহকারী অধ্যাপক কাজী আশরাফুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান চালু করা, বিভাগ খোলা, শিক্ষক নিয়োগের বিভিন্নপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তখন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে একটি অঙ্গীকারনামা করতে হয়। সেখানে তারা অঙ্গীকার করে যে, শিক্ষক-কর্মচারীদের যাবতীয় বেতনভাতা শতভাগ তারা বহন করবে।
এ হিসাবে সরকারি নীতিমালায় স্পষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অবশ্য দায়িত্ব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান থেকে উপযুক্ত ভাতাদি প্রদান করা। আর অনুমোদনের বাইরে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিলে পূর্ণ দায়ভার তো অবশ্যই তাদের বহন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো এ দায়িত্ব পালন করছে কি না সরকারের অন্তত এ বিষয়ে নজরদারি করা উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement