২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গার্মেন্ট শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

-

তৈরী পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উদ্যোক্তাদের দাবি, বাড়তি ৫১ শতাংশ মজুরি পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেয়া দিয়েছে। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, তবে কি এতদিন ৫১ শতাংশ লাভ হচ্ছিল? পরিস্থিতির উত্তরণে ধাপে ধাপে মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যেও অর্ডারমূল্য বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। জোর দেন শ্রমিকের দক্ষতা বাড়িয়ে কম দামি পণ্য উৎপাদন থেকে সরে এসে বেশি দামি পণ্য উৎপাদনের ওপর।
রফতানি বাণিজ্যে ৮৮ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে সরকার। দীর্ঘদিনের চর্চা অনুযায়ী শ্রমিক-মালিক এবং নিরপেক্ষ সদস্য নিয়ে একজন সিনিয়র জেলা জজের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি মজুরি নির্ধারণের রেওয়াজ থাকলেও এবারই প্রথম মজুরি নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের অবস্থানের মাঝামাঝি পর্যায়ে আট হাজার টাকা সর্বনি¤œ মজুরি নির্ধারণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন শ্রমিকেরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব আঁকড়ে রাখা মালিক সমিতির নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বিনাবাক্যে মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ সাধারণ উদ্যোক্তারা। ৮১ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন সেটি প্রতিপালনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিল্পমালিকেরা। তাদের আশঙ্কা, বাড়তি ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ হয়ে নতুন করে বন্ধ হয়ে যাবে আরো অনেক কারখানা।
পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মজুরি বেড়েছে ৫১ শতাংশ। মনে করেন একটি ফ্যাক্টরির শ্রমিক মাসিক বেতন বর্তমানে আসে এক কোটি টাকা। নতুন কাঠামো অনুযায়ী ওই মালিককে এখন বেতন দিতে হবে এক কোটি ৫১ লাখ টাকা। তাহলে কি ওই ফ্যাক্টরি বিগত দিনে মাসে ৫১ লাখ টাকা হারে লাভ করেছে? অসম্ভব! এখন এ বাড়তি টাকাটা আসবে কোত্থেকে? জায়গা একটাই, বায়ারদের কাছ থেকে ফিনিশড পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিতে হবে। অথবা অন্য খরচ কমাতে হবে। যদিও এটা অনেক কঠিন। কারণ দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সবকিছুরই বিল দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
বায়াররা দাম না বাড়ানোর কারণে এক সিজন অর্ডার ফিরিয়ে দেয়ায় তার কোম্পানির রফতানি ৪০ শতাংশ নেমে এসেছে জানিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কিন্তু খরচ তো আর কমেনি, মাস শেষে শ্রমিকের বেতনসহ ফ্যাক্টরির যাবতীয় খরচ, ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধÑ কোনো কিছুই কিন্তু থেমে থাকেনি। গত এক বছরেও সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
পণ্যের দাম চাইলেই বাড়ানো যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি রিফিউজ করলে কী হবে? অর্ডার তো আর আমার জন্য অপেক্ষা করেনি, হয় আমার দেশেরই অন্য কোনো ফ্যাক্টরি নিয়েছে অথবা অন্য কোনো দেশে অর্ডার চলে গেছে। কম দামে অর্ডার নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, অর্ডার না নিয়ে গত ছয় মাসে ছয় কোটি টাকা লসসহ গত এক বছরে প্রায় আট কোটি টাকার একটা বড় ঘাটতিতে পড়েছি। কম দামে যারা অর্ডার নিচ্ছে তারা অর্ডার নিয়ে হয়তো লস করেছে ২৫ লাখ, না নিলে লস হতো এক কোটি টাকা। বিষয়টি যদি এ রকম হতো যে অর্ডার না নিয়ে ফ্যাক্টরি তিন মাস বা ছয় মাস বন্ধ রাখলে কোনো খরচ নেই, তাহলে অর্ডার না নেয়ার মতো আপনার সহজ পরামর্শটা সানন্দে গ্রহণ করা যেত।
মোহাম্মদ হাতেমকে প্রশ্ন করা হয়, কম দামি পণ্য না বানিয়ে চীনাদের মতো দামি পোশাকের অর্ডার নেন না কেন? জবাবে তিনি বলেন, যে দেশে শ্রমিকের উৎপাদন দক্ষতা ৪০ শতাংশ সে শ্রমিক দিয়ে কম দামি পণ্য ছেড়ে বেশি দামি পণ্য বানানোর মতো অবস্থা এখনো হয়নি। তবে হ্যাঁ, বাঁচতে হলে আমাদের শ্রমিকের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং দামি পোশাক বানানোর কাজ নিতে হবে। অন্যথায় বাড়তি মজুরি পরিশোধ করতে গিয়ে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের সাথে কাউন্সিলিং করতে হবে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, মাইন্ডসেট করাতে হবেÑযেহেতু বেতন বেড়েছে, উৎপাদনও বাড়াতে হবে, অন্যথায় টিকে থাকা অসম্ভব।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে টি প্যাকেজিং শিল্প শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি ছিল ২১৬০ টাকা। ২০১৭ সালে এ শিল্প শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণকালে নি¤œতম মজুরি দাঁড়ায় ৭৮৮০ টাকা। মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ২২৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্প শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি ছিল ৪৬২৫ টাকা, যা ২০১৭ সালে পুনঃনির্ধারণের পর দাঁড়ায় ১৬০০০ টাকা। তাদের ক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ২৪৬ শতাংশ। ২০১১ সালে কটন টেক্সটাইল শিল্প শ্রমিকদের নি¤œœতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৩৩০২.৫০ টাকা। ২০১৮ সালে কটন টেক্সটাইল শিল্প শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত হয় ৫৭১০ টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার দেখা যায় ৭৫ শতাংশ। দর্জি কারখানা শিল্প শ্রমিকদের ২০০৮ সালে নি¤œতম মজুরি ছিল ২৩২৫ টাকা। ২০১৮ সালে এদের মজুরি নির্ধারিত হয় ৪৮৫০ টাকা। এদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিমাণ ১০৯ শতাংশ। ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প সেক্টরে শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি ২০০৯ সালে ছিল ৩৬২৫ টাকা। ২০১৭ সালে এই মজুরি পুনঃনির্ধারিত হয় ৮০৫০ টাকা। এতে বৃদ্ধির পরিমাণ ১২২ শতাংশ।
তৈরী পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরি সর্বপ্রথম নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এটি পোশাক শিল্পবিষয়ক প্রথম মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত। এ বোর্ড ঘোষিত শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি ছিল ৬২৭ টাকা। পোশাক শ্রমিকদের জন্য দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড গঠিত হয় নির্ধারিত পাঁচ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর পর, ১৯৯৪ সালে। দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নি¤œতম মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা, যা প্রথম মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির ৪৮ শতাংশের অধিক। পোশাক শ্রমিকদের জন্য তৃতীয় মজুরি বোর্ড গঠিত হয় নির্ধারিত পাঁচ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর পর, ২০০৬ সালে। তৃতীয় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নি¤œতম মজুরি ছিল ১৬৬২.৫০ টাকা, যা দ্বিতীয় মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির চেয়ে ৭৮ শতাংশের অধিক। চতুর্থ মজুরি বোর্ডটি নির্ধারিত পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে চার বছরের মাথায় ২০১০ সালে গঠিত হয়। চতুর্থ মজুরি বোর্ড ঘোষিত সর্বনি¤œ মজুরি ছিল ৩০০০ টাকা, যা তৃতীয় মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির ৮০ শতাংশের অধিক। চতুর্থ মজুরি বোর্ডের মতো পঞ্চম মজুরি বোর্ডটিও পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালে গঠিত হয়। পঞ্চম মজুরি বোর্ড ঘোষিত নি¤œতম মজুরি ছিল ৫৩০০ টাকা, যা চতুর্থ মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির চেয়ে ৭৬ শতাংশের অধিক। আর এবার গঠিত ষষ্ঠ মজুরি বোর্ড আগের মজুরি থেকে ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement