১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


মলদ্বার না কেটে অত্যাধুনিক পাইলস অপারেশন

-

জীবনে কম-বেশি পাইলসের সমস্যায় ভোগেননি এরূপ লোকের সংখ্যা খুব কম। পাইলস বলতে আমরা বোঝাই মলদ্বারে রক্ত যাওয়া, ব্যথা হওয়া, ফুলে ওঠা, মলদ্বারের বাইরে কিছু অংশ ঝুলে পড়া আবার ভেতরে ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি। এর চিকিৎসা হিসেবে আদিকাল থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি চলে এসেছে। যেমন- ইনজেকশন পদ্ধতি, রিংলাইগেশন পদ্ধতি ও অপারেশন। ইনজেকশন পদ্ধতি ১৮৬৯ সালে আমেরিকায় শুরু হয়। এ পদ্ধতি প্রাথমিক এবং ছোট পাইলসে ভালো ফল দেয় কিন্তু সুফল দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এরপর ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ডে রিংলাইগেশন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। রিংলাইগেশন পদ্ধতির ফলাফল খুব ভালো। ৮০-৯০ শতাংশ পাইলস রোগী এ পদ্ধতিতে ভালো হন। কিন্তু শতকরা ১০-২০ ভাগ রোগীর অপারেশন প্রয়োজন। বিশেষ করে যাদের পাইলস বড় হয়েছে এবং বাইরে বেরিয়ে আসে। এ অবস্থায় প্রচলিত আধুনিক পদ্ধতিতে আমরা অপারেশন করে থাকি। এ অপারেশনে মলদ্বারের চতুর্দিকে তিন জায়গায় বেশ কিছু জায়গা কেটে ফেলে দিতে হয়। যার ফলে অপারেশনের পর প্রচুর ব্যথা হয়, মলত্যাগের পর ব্যথা বেড়ে যায়, অনবরত সামান্য রক্ত ও পুঁজের মতো নিঃসরণ হয়। যার ফলে তস্থান শুকাতে এক-দুই মাস সময় লাগে। অফিস থেকে কমপে এক মাস ছুটি নিতে হয় অপারেশনের পর ত্রেভেদে মলদ্বার সঙ্কুচিত হয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তোলে আবার পায়খানা আটকিয়ে রাখার মতা ব্যাহত হতে পারে। এরূপ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রোগীকে এক থেকে দেড় মাস কাটাতে হতে পারে। মলদ্বারের চতুর্দিকের মাংস কাটার জন্য মলদ্বারের ভেতরের অনুভূতি কমে যায়। যার জন্য মল আটকে রাখার মতার তারতম্য হতে পারে।
এহেন প্রোপটে অধ্যাপক ডা: এন্টনিও লংগো, অধ্যাপক সার্জারি, ইউনির্ভাসিটি অব প্যালেরমো, ইতালি ১৯৯৩ সালে একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার নাম Longo Operation বা Stapled Haemorrhoidectomy । অর্থাৎ অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে মলদ্বার না কেটে পাইলস অপারেশন। এ পদ্ধতির Concept বা চিকিৎসার দর্শন যুক্তি সম্পূর্ণ আলাদা। এ ক্ষেত্রে পাইলসটিকে একটি ঝুলে পড়া মাংসপিণ্ড হিসেবে মনে করা হয়। এই ঝুলে পড়া মাংসপিণ্ডের ভেতর অসংখ্য শিরা মলত্যাগের সময় প্রচণ্ড চাপে রক্তপাত ঘটায়। বিশেষ ধরনের যন্ত্রের (Hemorrhoidal circular stapler, Elthicone Endosurgery, USA) সাহায্যে অপারেশনের ফলে ঝুলে পড়া পাইলস ভেতরে ঢুকে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এ পদ্ধতিতে আসলে পাইলসের স্থানে বা মলদ্বারে কোনো কাটা ছেঁড়া হয় না। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে কাটা ছেঁড়া হয়। তবে তা মলদ্বারের অনেক গভীরে। এই যন্ত্রটি রেকটামের ভেতর একটি চক্রাকার মাংসপিণ্ড কেটে নিয়ে আসে। কাটা ছেঁড়া করে ওই যন্ত্রটিই আবার সেলাইও সেরে দেয়। যার কারণে কোনো তস্থান থাকে না। আর তস্থান থাকে না বলে শুকানোর প্রশ্ন আসে না। মলদ্বারের অনেক গভীরে যে স্থানটির নাম রেকটাম সেখানে কোনো ব্যথার অনুভূতি নেই। তাই এই অপারেশনের পর কোনোরূপ ব্যথা হয় না। তবে মলদ্বারে কিছু নাড়াচাড়া করা হয়, যার ফলে অপারেশনের পর অল্প ব্যথা হতে পারে। এ পদ্ধতিতে পাইলসের উৎপত্তিস্থল অর্থাৎ রেকটামের ভেতর অপারেশনের ফলে পাইলসের রক্ত সরবরাহের শিরাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে গঠনগত দিক থেকে মলদ্বার সম্পূর্ণ অত থাকে। মলদ্বারে সামান্যতম কোনো কাটা ছেঁড়া নেই। এটিই এই অপারেশনের নতুন দিক। যার কারণে অপারেশনের পর প্রচণ্ড ব্যথা নেই। রক্ত বা পুঁজ পড়ার সমস্যা নেই। তস্থান শুকানোর জন্য দেড় মাস সময় দরকার নেই। মলদ্বার সরু হয়ে যাওয়ার সমস্যা নেই। দীর্ঘ দিন ব্যথার ওষুধ ও এন্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন নেই। দীর্ঘ দিন বিশ্রাম বা ছুটি নেয়ার প্রয়োজন নেই। পায়খানা আটকে রাখার মতা ব্যাহত হওয়ার ভয় নেই। সর্বোপরি আবার পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা অতি সামান্য অর্থাৎ শতকরা দুই ভাগ।
এ অপারেশনে অজ্ঞান করা হয় না তবে কোমরের নিচের দিক অবশ করা হয়। অপারেশনের জন্য রোগীকে ২-৩ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। একটি অত্যাধুনিক বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করতে হয় যেটি কিছুটা ব্যয়বহুল অর্থাৎ যন্ত্রটির মূল্য ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু এ পদ্ধতির সুবিধাগুলো পর্যালোচনা করলে প্রায় সব রোগীই এতটুকু ত্যাগ স্বীকারে রাজি হবেন। ৫-১০ দিনের মধ্যে রোগী স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন। অন্য দিকে সাধারণ অপারেশন হলে রোগীকে এক থেকে দেড় মাস ছুটি নেয়া লাগতে পারে।
বিগত শোল বছর যাবত আমরা মলদ্বারের চিকিৎসা করে আসছি এবং এ পর্যন্ত ৬৬৬৩৫ রোগীর চিকিৎসা ও অপারেশন করেছি। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায় এ রোগের ওপর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি। আমাদের দেশের রোগীরা ২০-৪০ বছর পাইলস নিয়ে ভোগেন কিন্তু অপারেশনের পরের যন্ত্রণার কথা ভেবে ভয়ে কোনো ডাক্তারই দেখান না।
৮ জুন ২০০৩ সালে আমি প্রথম এই অত্যাধুনিক অপারেশন সাফল্যের সাথে বাংলাদেশে সম্পাদন করি। এরপর বিগত ১৪ বছরে আমরা এ জাতীয় কয়েক হাজার অপারেশন করে খুবই ভালো ফলাফল পেয়েছি। অল্প কিছু রোগীর সামান্য সমস্যা হয়েছে। জনৈক রোগী অপারেশনের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন- স্যার, বিশ বছর ভয়ে অপারেশন করলাম না। এখন মনে হচ্ছে এটি কোনো অপারেশনই না। আত্মীয়স্বজন বলেন তোমার কি আসলেই অপারেশন হয়েছে? কোনো ব্যথা নেই, রক্ত পড়া নেই, গরম পানির সেঁক দেয়া নেই ইত্যাদি। বিদেশে যেখানে এ জাতীয় অপারেশনে কয়েক লাখ টাকা খরচ হবে সে তুলনায় আমাদের দেশে খরচ অত্যন্ত সীমিত। আমি মনে করি সব মধ্যবিত্তের আওতায় থাকবে। রোগীরা পাইলস অপারেশন করতে চান না কয়েকটি কারণে যেমন অপারেশনের পর মলত্যাগে ব্যথা হওয়া, ঘা শুকাতে দীর্ঘ দিন লাগা, দীর্ঘ দিন বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন, পায়খানা আটকে রাখার মতা ব্যাহত হওয়ার ভয়, মলদ্বার সরু হয়ে যাওয়ার ভয় এবং পাইলস আবার হওয়ার ভয় ইত্যাদি। এ পদ্ধতিতে এ জাতীয় সব সমস্যার পূর্ণ সমাধান রয়েছে।
পদ্ধতির তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা
ক্র.নং বিবরণ লংগো অপারেশন প্রচলিত পদ্ধতি ১। মলদ্বারে কাটা ছেঁড়া নেই, কাটা ছেঁড়া করতে হবে ২। ব্যথা সামান্য ব্যথা প্রচুর ৩। মলত্যাগের পর ব্যথা সামান্য ব্যথা প্রচুর ৪। নিঃসরণ, রক্ত বা পুঁজ পড়া নেই, এক থেকে দেড় মাস ৫। রক্ত পড়া নেই মাঝে মধ্যে ৬। অপারেশনের সময় কিছুটা কম, কিছুটা বেশি ৭। গরম পানির সেঁক দেয়া প্রয়োজন নেই, বহু দিন দিতে হয় ৮। ব্যথার ওষুধ অল্প প্রয়োজন বহু দিন খেতে হবে ৯। এন্টিবায়োটিক দরকার দরকার ১০। ছুটি নিতে হবে ৭-১০ দিন কম বেশি ৩০ দিন ১১। হাসপাতালে থাকতে হবে ২-৩ দিন ৩-৫ দিন ১২। অপারেশনের পর সেরে ওঠা দ্রুত দীর্ঘ দিন লাগে ১৩। মলদ্বার সরু হয়ে যাওয়া হয় না মাঝে মধ্যে হয় ১৪। ভবিষ্যতে আবার পাইলস হওয়া হয় না ৩% ১৫। মলদ্বারের আকৃতি স্বাভাবিক থাকে স্বাভাবিক থাকে না ১৬। আলিশ বা পায়ুপথ বের হয়ে আসা এ পদ্ধতিতে আলিশ রোগের চিকিৎসা সম্ভব সম্ভব নয় ১৭। খরচ বেশি (একবার ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রের কারণে) আগের মতো, কম ১৮। রোগীর সন্তুষ্টি অনেক বেশি কম ১৯। পায়খানা ধরে রাখার মতা স্বাভাবিক ব্যাহত হতে পারে।

লেখক : বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, (অব:) কলোরেকটাল সার্জারিী বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা।
চেম্বার : ইডেন মাল্টি-কেয়ার হসপিটাল, ৭৫৩, সাতমসজিদ রোড, (স্টার কাবাবসংলগ্ন) ধানমন্ডি, ঢাকা। ফোন : ০১৭৫৫৬৯৭১৭৩-৬


আরো সংবাদ



premium cement