২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

২০ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে একুশে পদক প্রদান
একুশে পদক ২০২০ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : বাসস -

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখা এবং দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীতে এখন আর একা একটি দেশ চলতে পারে না, অন্য দেশকে সাথে নিয়েই চলতে হয় এবং জীবন-জীবিকার জন্য অন্য ভাষা শেখারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে নিজের ভাষাকে ভুলে যাওয়া, নিজের ভাষা বিস্মৃত হওয়া এটি আমাদের জন্য মোটেই ঠিক নয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ‘একুশে পদক-২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০ ব্যক্তি এবং এক প্রতিষ্ঠানকে এ বছর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসরকারি এ সম্মাননা ‘একুশে পদক’ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করা। একুশ শিখিয়েছে আত্মমর্যাদাবোধ। একুশের এই রক্তের অক্ষরেই লিখে রাখা হয়েছিল আগামী দিনে আমাদের স্বাধীনতা। শেখ হাসিনা বলেন, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। আমরা চাই এই গৌরবের ইতিহাস আমাদের দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন জানতে পারে। তিনি বলেন, মাতৃভাষা আন্দোলন শুধু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না। পক্ষান্তরে, এটি ছিল স্বাধিকার আদায়ের, স্বাধীনতার আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতার অংশবিশেষ উল্লেখ করেন।
জাতির পিতা বলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।’
উল্লেখ্য, ৫ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের একুশে পদক বিজয়ী হিসেবে ২০ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানসহ ২১ জনের তালিকা ঘোষণা করেন। পদকপ্রাপ্তরা হচ্ছেনÑ ভাষা আন্দোলনে মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশা (মরণোত্তর), শিল্পকলায় (সঙ্গীত) বেগম ডালিয়া নওশিন, শঙ্কর রায় ও মিতা হক, শিল্পকলায় (নৃত্য) মো: গোলাম মোস্তফা খান, শিল্পকলায় (অভিনয়) এম এম মহসীন, শিল্পকলায় (চারুকলা) অধ্যাপক শিল্পী ড. ফরিদা জামান, মুক্তিযুদ্ধে মরহুম হাজী আক্তার সরদার (মরণোত্তর), মরহুম আবদুল জব্বার (মরণোত্তর), মরহুম ডা: আ আ ম মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় জাফর ওয়াজেদ (আলী ওয়াজেদ জাফর), গবেষণায় ড. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ-কারি আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ ছাইফুর রহমান নিজামী শাহ, শিায় অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, অর্থনীতিতে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, সমাজসেবায় সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ভাষা ও সাহিত্যে ড. নুরুন নবী, মরহুম সিকদার আমিনুল হক (মরণোত্তর) ও কবি-সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা বেগম নাজমুন নেসা পিয়ারি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রসূতি মায়ের জীবন রক্ষায় সায়েবা’স কীটের উদ্ভাবক অধ্যাপক ডা: সায়েবা আখতার। পাশাপাশি ‘গবেষণা’য় একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
পদক বিজয়ীরা প্রত্যেকে নিজে এবং মরণোত্তর পদক বিজয়ীদের পক্ষে তাদের ছেলে ও মেয়েরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষে পদক গ্রহণ করেন এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মহান আত্মত্যাগ স্মরণে সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন েেত্র বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩ তোলা ওজনের ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের তৈরি একটি স্বর্ণপদক, পুরস্কারের অর্থের চেক এবং একটি সম্মাননাপত্র প্রদান করা হয়।
সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো: আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা, বিচারপতিরা, সংসদ সদস্যরা, তিন বাহিনী প্রধানগণ, সরকারের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারাসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পদকপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে যারা একুশে পদক পেয়েছেন তারা আমাদের গুণীজন। তারা নিজ নিজ েেত্র কীর্তিমান। দেশ-জাতি-ভাষায় তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। সেই অবদানের কথা সবসময় আমরা স্মরণ করি।’
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি এই সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যাতে কেউ মুছতে না পারে; সে লক্ষ্য নিয়েই পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ নামে মোট ১৪ খণ্ডের বই প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি একটার পর একটা ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা এ দেশে দীর্ঘ দিন চলেছে, প্রায় ২১টি বছর। কাজেই আমি চেয়েছি, সত্যটা মানুষের জানা দরকার।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বই দুটো ইতিহাসের অনেক বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরবচ্ছিন্ন অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকেই জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত এবং ভাষার দাবিতে আন্দোলন, সংগ্রাম আর ভাষণ দিতে গিয়ে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন জাতির পিতা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে লিখেছেনÑ ‘পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে।’ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী কানাডা প্রবাসী বাঙালি সালাম ও রফিকের অবদানের কথাও এ সময় স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এ সময় বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষাগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং এ নিয়ে গবেষণার জন্য তার সরকারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement