২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে সংশয়

-

এক অঙ্কে সুদহার নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রায় এক বছর পার হতে চলছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের শর্ত হিসেবে ব্যাংক উদ্যোক্তারা চার ধরনের সুবিধাও ভোগ করছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনেনি বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক। গত ৩১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে ব্যাংক মালিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করায় আবারো নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকাররা। এক এপ্রিল ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ব্যাংক পরিচালকেরা কী ধরনের সুবিধা নিয়েছিলেন তা সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে গত ১৫ এপ্রিল সব ব্যাংকের ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানসম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো: সিরাজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার শর্তে ব্যাংকগুলো চার ধরনের সুবিধা ভোগ করছে। এ সুবিধার মধ্যে ছিল করপোরেট ট্যাক্স ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করা, বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা, সরকারি টাকা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখা এবং আপদকালীন সঙ্কট মেটাতে স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার হার পৌনে সাত শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। এসব সুবিধা ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে ভোগ করলেও তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেশির ভাগ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনেনি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়নি। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য সুপারিশ করেছে। তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেসব ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে সরকার যে ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে সুপারিশ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
জানা গেছে, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে এবং তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারমান্য নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন গত বছরের ২০ জুন। কিন্তু ঘোষণার প্রায় ১০ মাস পার হতে চললেও ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনেনি বেশির ভাগ ব্যাংক। আবার সর্বশেষ সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন ঋণের সুদহার ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এ ঘোষণাও ৯ মাস অতিবাহিত হতে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বেশির ভাগ ব্যাংকের গড় ঋণের সুদহার এখনো ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গড় ঋণের সুদহার এখনো কোনো কোনো ব্যাংকের সাড়ে ১৩ শতাংশ রয়েছে। আর খাত ভেদে সুদহারও তো আরো অনেক বেশি।
জানা গেছে, ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে আনা হয়। ব্যাংকগুলো মুনাফার ওপর ৪০ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স দিতো। কিন্তু ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার শর্তে প্রথমে এ হার সাড়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়। এতে সরকার আয় থেকে বঞ্চিত হলেও ব্যাংকগুলোর নিট আয় বেড়ে যায়।
ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত নিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে সাড়ে ছয় টাকা নগদে জমা (সিআরআর) রাখত। আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই এ অর্থ জমা রাখা হয়। এর ওপর কোনো সুদ বা মুনাফা পায়না ব্যাংকগুলো। ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিআরআর হার ১ শতাংশ কমিয়ে নেয় ব্যাংক পরিচালকরা। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর হাতে ১০ হাজার কোটি টাকা চলে যায়। এতে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নেয় ব্যাংকগুলো। যাকে ব্যাংকিং ভাষায় রেপো বলা হয়। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে আগে প্রতি ১০০ টাকার জন্য পৌনে সাত টাকা সুদ গুনতে হতো। কিন্তু ব্যাংক পরিচালকরা ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। এতে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার প্রাপ্তি সহজ হয়ে যায়। আবার সরকারি অর্থ ৭৫ শতাংশ সরকারি ব্যাংকে এবং ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে আমানত রাখা হতো। কিন্তু ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার শর্তে সরকারি অর্থ ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ আমানত রাখার সুবিধা নেয়া হয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানো ছাড়া ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব হবে না। কেননা কম সুদে আমানত মিলছে না। খোদ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশের কমে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। প্রশাসনিকব্যয়সহ ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় কমপক্ষে সাড়ে তিন থেকে ৪ শতাংশ রয়েছে। ৯ শতাংশের সাথে ৪ শতাংশ যোগ করলে ১০০ টাকার আমানত ১৩ শতাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এরওপর বড় বড় শিল্পগ্রুপ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছে না। এতে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। খেলাপি ঋণের কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে। পরিচালন ব্যয়ও রাতারাতি কমানো সম্ভব হবে না। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া। সব মিলে ঋণের সুদহার কমানো আদৌ সম্ভব হবে না বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোর সুদহারের ওপর সরকারের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে সঞ্চয়পত্রে আমানতের সুদহার কমাতে হবে। এ ছাড়া ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনা শুধু ঘোষণাতেই বন্দী থাকবে।


আরো সংবাদ



premium cement