২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর দাফন সম্পন্ন

-

দেশের বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় বারিধারায় নিজ বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। গতকাল বাদ জোহর বারিধারার ৯ নম্বর রোডের পার্ক মসজিদে শাহনাজ রহমতুল্লাহর নামাজে জানাজা শেষে বনানী সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। স্বামী মেজর (অব:) আবুল বাশার রাহমতুল্লাহ ব্যবসায়ী, মেয়ে নাহিদ রাহমতুল্লাহ থাকেন লন্ডনে আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রাহমতুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় বাস করছেন।
শাহনাজ রহমতুল্লাহ ১৯৯২ সালে একুশে পদক পান। ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবিতে গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ আয়োজনে আজীবন সম্মাননা, ২০১৩ সালে সিটি ব্যাংক থেকে তাকে গুণীজন সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ ছাড়া গান গেয়ে আরো অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করা এ শিল্পী ১০ বছর বয়স থেকেই গান শুরু করেন। এরপর গান করেন চলচ্চিত্র, টেলিভিশন আর বেতারে। গজলসম্রাট মেহেদি হাসানের শিষ্য হয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গানের কথা বলতে গেলে সবার আগেই চলে আসে তার নাম। তার ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন সুরকার, আরেক ভাই চিত্রনায়ক জাফর ইকবালও করতেন গান। গানের ক্ষেত্রে তাদের মায়ের অনুপ্রেরণাই ছিল বেশি।
তিনি ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তির সাথে সময় থাকতেই গান থেকে বিদায় নেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ওমরাহ করে আসার পর আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। ৫০ বছরের ওপরে গান গেয়েছি, আর কত গাইব?’
১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন এই শিল্পী। গানের জগতে ৫০ বছরে তার চারটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি ছিল প্রণব ঘোষের সুরে ‘বারটি বছর পরে’, তারপর প্রকাশিত হয় আলাউদ্দীন আলীর সুরে ‘শুধু কি আমার ভুল’।
তার গাওয়া অসংখ্য গান বাংলাদেশের অগণিত শ্রোতার মন জয় করেছে। এর মধ্যে আছে ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে আমায় বল’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘কে যেন সোনার কাঠি’, ‘মানিক সে তো মানিক নয়’, ‘যদি চোখের দৃষ্টি’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘খোলা জানালা’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি’, ‘আরো কিছু দাও না’, ‘একটি কুসুম তুলে নিয়েছি’।
শিল্পীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে দেখতে বারিধারার বাসায় ছুটে যান কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ, শফিক তুহিন ও গীতিকার কবির বকুল ও গাজী মাঝহারুল আনোয়ারসহ অনেকে। তারা সবাই মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
বিবিসির তালিকায় ৪ গান : বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান পেয়েছিল শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া চারটি গান। গানগুলো হলোÑ খান আতাউর রহমানের কথা ও সুরে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ আর ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’।
সন্তানদের ছাড়াই দাফন : স্বামীর সিদ্ধান্তে দুই ছেলে-মেয়ে ছাড়াই দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে শাহনাজ রহমতুল্লাহর লাশ। এ বিষয়ে তার স্বামী আবুল বাশার রহমতুল্লাহ বলেন, ‘যে গেছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না। ছেলে কবে আসতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই। টিকিট পাওয়ার বিষয় আছে। সে এলে দোয়া অনুষ্ঠানে অংশ নেবে। আপনারা সবাই দোয়া করবেন।’
যে কারণে গান ছেড়েছিলেন : কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে গান ছেড়ে দিয়েছিলেন কিংবদন্তি এই শিল্পী। গণমাধ্যমেও ছিলেন অনুপস্থিত। ধর্ম-কর্মে বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হঠাৎই গানের ভুবন থেকে নিজেকে কেন সরিয়ে নিলেন গণমাধ্যমকর্মীর এমন প্রশ্নে সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, নামাজ পড়েই সময়টা বেশ কাটছে। ওমরাহ করে আসার পর দিন থেকেই আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। তিনি জানিয়েছিলেন, পবিত্র কাবা, মহানবী সা:-এর রওজা শরিফ দেখে আসার পর থেকে পার্থিব বিষয়ে আগ্রহী নন তিনি। বাকিটা জীবন সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতায় প্রার্থনা করেই কাটাতে চান। এ ছাড়া টিভি দেখেন না, রেডিও শোনেন না বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
তা হলে সময় কাটে কিভাবে এমন প্রশ্নে তিনি জানিয়েছিলেন, ভোর ৪টায় ঘুম থেকে ওঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। ফজর পর্যন্ত জায়নামাজে অপেক্ষা করতে থাকেন। ওয়াক্ত হলে ফজর পড়ে কুরআন শরিফ পড়া শুরু করেন। একজন হুজুর বাসায় এসে পবিত্র কুরআন শিখিয়ে যান বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ আরো কিছু ধর্মীয় কাজ সারেন। এশার নামাজ শেষে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন যেন পরবর্তী দিনে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে জাগতে পারেন। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, এখন হজে যাওয়াই মূল লক্ষ্য। হাঁটুতে ব্যথার কারণে হাঁটতে পারছেন না। একটু সুস্থ হলেই স্বামীর সাথে হজে যাবেন।
তথ্যমন্ত্রীর শোক
বাসস জানায়, কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
গতকাল এক শোকবার্তায় তথ্যমন্ত্রী বলেন, দেশাত্মবোধক গানে এ দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক কণ্ঠস্বর শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তার কণ্ঠের কালজয়ী দেশাত্মবোধক অজস্র গানের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন।
তিনি মরহুমার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।


আরো সংবাদ



premium cement