২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার

তর্ক-বিতর্কের ডামাডোলে

-

নোবেল প্রাইজ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি কি না, একজন লেখকের অমরত্বপ্রাপ্তির চূড়ান্ত সার্টিফিকেট কিনা, এ পুরস্কার না পেলে একজন লেখকের অস্তিত্ব আস্তে আস্তে কালের পৃষ্ঠা থেকে মুছে যাবে কিনা তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, নানা সময়ে নানা তর্ক-বিতর্ক উঠলেও এখনো পর্যন্ত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার এই নোবেল। সমগ্র বিশ্বের সাহিত্যমহল এখনো ঘোরের মধ্যে থাকে লোভনীয় এই সাহিত্য-পুরস্কারটি নিয়ে। যদিও এ পুরস্কারটি এর জন্মলগ্ন থেকেই নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এবং হাল আমলে বিতর্কিত ও অযোগ্য ব্যক্তিদের পুরস্কার দেয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তারপরও এর আভিজাত্য ও অর্থমূল্যের গৌরব এখনো বিশ্বের কবি-সাহিত্যিকদের মোহগ্রস্ত করে রাখে, সন্দেহ নেই।
১৯০১ সালের সুলি প্রুধোম থেকে শুরু করে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের ওলগা টোকারচুক ও পিটার হ্যান্ডকে পর্যন্ত যেসব ভাগ্যবান কবি-সাহিত্যিক নোবেল প্রাইজ লাভ করেছেন, তাঁদের বাইরেও এ সময়কালে, এমন সব অমর কবি-সাহিত্যিক বেঁচেছিলেন, যাঁদের বাদ দিয়ে আধুনিক সাহিত্যের কথা কল্পনাও করা যায় না অথচ পুরস্কার দেয়া হয়নি তাঁদের। কেন দেয়া হয়নি, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেও থাকতে হয়তো পারে, কিন্তু দেয়া যে হয়নি তাঁদের, নিষ্ঠুরতম এ সত্যের কারণে এ পুরস্কারটিই ওজন হারিয়ে ফেলেছে শেষ পর্যন্ত। যারা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যেমন অনেক মহীরুহ, পাতিগাছ ও আগাছা; তেমনি যাঁদের দেয়া হয়নি এ পুরস্কার, তাঁদের মধ্যেও এমন সব বিশাল বটবৃক্ষ রয়েছেন যে, অরণ্যের দিকে তাকালে শুধু তাঁদের চোহারাই চোখে পড়ে।
লিও টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০), আন্তন চেখভ (১৮৬০-১৯০৪), জুল ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫), হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬), ফ্রানৎস কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪), জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), নাজিম হিকমত (১৯০২-১৯৬৩), হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬)- এঁদের বাদ দিয়ে কি আধুনিক সাহিত্য কল্পনা করা যায়? অথচ এঁরাই বাদ পড়ে গেছেন নোবেল প্রাইজের তালিকা থেকে। কিন্তু এঁদের নিয়েই তো মেতে আছে তাঁদের নিজ নিজ দেশ ও জাতি, সেইসাথে বিশ্বের সাহিত্যামোদী মানুষেরাও।
সাহিত্যের জন্য নোবেল প্রাইজের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। ২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ বিজয়ী অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হ্যান্ডকে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে এ পুরস্কার নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন তা-ই যথেষ্ট এ প্রশ্নের উত্তর পেতে। বিতর্কিত এই লেখক এক সময় অস্ট্রিয়ান নিউজপেপার ‘ডাই প্রেস’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নোবেলপ্রাইজ শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত’। তিনি এ সাহিত্য পুরস্কারকে বলেছিলেন ‘সাহিত্যের মিথ্যা সিদ্ধ ঘোষণা’। সেøাভেনিয়ান দার্শনিক জিজেক যথার্থই বলেছেন যে, ‘এবারের নোবেল পুরস্কার এটাই প্রমাণ করে যে, হ্যান্ডকে ঠিক কথাটাই বলেছিলেন।’
পিটার হ্যান্ডকেকে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ দেয়ার ঘোষণায় দাবানলের মতো ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। সমালোচকরা এটাকে বলছেন লজ্জাকর ঘটনা। বলা হচ্ছে, সম্মানজনক এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি সর্বজনস্বীকৃত গণহত্যাকে গণহত্যা বলতে অস্বীকার করেছেন। ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণকারী অস্ট্রিয়ান এই লেখক আগাগোড়াই ছিলেন বিতর্কিত, যিনি ১৯৯০-এর দশকে সংঘটিত যুগোসøাভ যুদ্ধ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন বারবার; তিনি ছিলেন সভ্যতার জঘন্য হত্যাযজ্ঞের নায়ক সার্বিয়ান নেতা সেøাবাদান মিলোসেভিচের একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র, আন্তর্জাতিক আদালত যাকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করে।
হ্যান্ডকের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ঘোষণায় প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে বসনিয়া, আলবেনিয়াসহ বিশ্বময়। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কসোভোর রাষ্ট্রদূত ভেøারা ছিটাকু এক টুইটবার্তায় জানান যে, এটা একটা ‘লজ্জাকর সিদ্ধান্ত’। তিনি আরো লেখেন যে, ‘গণহত্যাকে অস্বীকারকারী ও মিলোসেভিচের জন্য দুঃখপ্রকাশকারীকে কিছুতেই বরণ করে নেয়া উচিত হবে না। আমরা অবশ্যই তাদের সমর্থন করতে পারি না, যারা ঘৃণা উগরে দেয়।’
আলবেনিয়ার ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেন্ট চাকাজ হ্যান্ডকের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির খবরে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত নিচ ও লজ্জাকর। সাহিত্যের শাশ্বত সৌন্দর্যে ও মানুষের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার সাহিত্যের যে ক্ষমতা, সে-ক্ষমতায় দৃঢভাবে বিশ্বাসকারী একজন মানুষ হিসেবে এবং গণহত্যা ও জাতিনির্মূলকরণের একজন প্রত্যক্ষ শিকার হিসেবে নোবেল কমিটির এ ধরনের সিদ্ধান্তে আমি খুবই আতঙ্কিত।’
সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস ম্যালম অবশ্য দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন যে, কমিটি কেবল সাহিত্যিক ও নান্দনিক গুণাবলির ভিত্তিতেই বিজয়ীকে বাছাই করেছে এবং একাডেমির জন্য এরকম বাধ্যবাধকতা নেই যে, তাকে রাজনৈতিক বিবেচনার বিপরীতে সাহিত্যমূল্যের সমন্বয় করতে হবে। সুইডিশ একাডেমির দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে ম্যাটস ম্যালম এরকম মন্তব্য করতে পারেন কিনা, তা নোবেলপ্রাইজের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের এই পুরস্কার প্রবর্তনের উদ্দেশ্যের কথা জানলেই বোঝা যায়। আলফ্রেড নোবেলের উইলে বলা হয়েছে, ‘এই পুরস্কার প্রদান করা হবে রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি, পদার্থ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে, মানবতার জন্য অসামান্য অবদান রাখার কারণে।’ মানবতার জন্য অসামান্য অবদান রাখার কারণেই যদি এ পুরস্কার প্রদান করার কথা থেকে থাকে, তাহলে পিটার হ্যান্ডকের মতো একজন মানবতাবিরোধী লেখককে এ পুরস্কার প্রদান করা যায় কিনা, তা ম্যাটস ম্যালমের মতো ব্যক্তিরা বুঝতে না পারলেও পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষেরা ঠিকই বোঝে। পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে পুরস্কারপ্রদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটি পক্ষান্তরে ঘাতকদেরই, মানবতাবিরোধীদেরই প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছে। বিশ্ববিবেক এতে ক্ষতবিক্ষত না হয়ে পারে না। এটা ভাবাও অমূলক হবে না যে, সাহিত্যে নোবেলপ্রাইজ প্রদানকারী কমিটি হয়তো আগের অবস্থানে আর নেই। বিগত কয়েক বছরের পুরস্কার বিজয়ীদের নামের তালিকা দেখলে তা-ই মনে হয়। হয় তারা ভালো ও সৎ সাহিত্য নির্বাচন করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন, না হয় গোপন কোনো ভিন্নতর উদ্দেশ্য পূরণের উদ্দেশ্যে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন।
ভতলানা আলেক্সিয়েভিচ কিংবা পিটার হ্যান্ডকে-কে পুরস্কৃত করা আর টি এস ইলিয়ট কিংবা সিমাস হিনিকে পুরস্কৃত করা কখনো একই ব্যাপার হতে পারে না। যে কমিটি এর আড়ালে কাজ করছে, তাদের রুচির আলোকেই বিশ্বের সাহিত্য রচিত হতে হবে, তার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সাহিত্যকে অর্থ দিয়ে, খ্যাতি দিয়ে কিংবা ক্ষমতা দিয়ে শাসন করা যায় না। লিও টলস্টয় পুরস্কৃত না হয়েই মৃত্যুবরণ করতে পারেন কিন্তু তাঁর ওয়ার এ- পিস কিংবা আন্না কারনেনা এক অমর সৃষ্টি, যার আবেদন কখনো ফুরিয়ে যাবে না। নোবেল প্রাইজ পেলেই বা কি, না পেলেই বা কি, ইয়েটস-এর অমর সব কবিতার আবেদন সবসময় একই রকম। সুতরাং নোবেল প্রাইজ হোক আর পুলিৎজার পুরস্কার হোক, লেখককে পুরস্কারের দিকে তাকিয়ে সাহিত্য রচনা করলে চলে না, তাঁকে চলতে হয় খরস্রোতা নদীর মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাটি ও মানুষের ছবি আঁকতে আঁকতে সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের তাগিদে। যে সাহিত্য মানুষের কথা বলে না, জীবনের কথা বলে না, কেবলি মৃত্যুর কথা বলে, ধ্বংসের কথা বলে, সে সাহিত্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভালো আর তার জনক অবশ্যই পরিত্যাজ্য, যতই না ঢাক-ঢোল পেটানো হোক তাঁর নামে।

 


আরো সংবাদ



premium cement