২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৈয়দ আলী আহসান ‘এখানে নদীর মতো এক দেশ’

-

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকে আমাদের বাংলাভাষী দেশব্যাপী যে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক আন্দোলনের শুরু হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে বাংলা বিভাগ-প্রধান সৈয়দ আলী আহসান ও তাঁর সহকর্মীরা উপযুক্তভাবে ছাত্র-জনতাকে সঙ্ঘবদ্ধ করে সেদিন এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর পটভূমিরূপে পরবর্তীকালে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন :
‘আমার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল শুভ এবং কল্যাণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আমি সবসময় ভেবেছি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমার নিজস্ব সত্তার বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। আমার ভাষা এবং ধ্বনি বিনিময়, আমার বিবিধ ইচ্ছা এবং সঙ্কল্প, আমার আনন্দের অর্থ সবকিছুকে আবিষ্কার করতে হলে আমার নিজস্ব এবং স্বাধীন ভূ-কেন্দ্রের প্রয়োজন। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অর্থ ছিল আমার নিজস্ব সত্তাকে আবিষ্কার করার ইচ্ছা। আমি এই ইচ্ছাকে রূপ দেয়ার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে যে সক্ষম হয়েছিলাম এখানেই আমার গর্ব এবং অহঙ্কার।’ (যখন সময় এলো পৃষ্ঠা-৭)
এর অবশ্য একটা পটভূমি রয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছর করাচি অবস্থান, বারকয়েক বিদেশ ভ্রমণ শেষে বাংলা একাডেমি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁর চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটল। তাঁর স্বদেশ ভাবনায় দেখা দিলো এক নতুন পূর্ব বাংলার আবির্ভাব :
‘হঠাৎ নতুন প্রত্যাগত আমার কাছে
বন্য উচ্ছলতায় সবুজের ঔদার্য
এখানে আমার পৃথিবী অনেক
রূপময়ী
এখানে নদীর মতো এক দেশ
শান্ত, স্ফীত, কল্লোলময়ী
বিচিত্ররূপিণী অনেক বর্ণের রেখাঙ্কন
এ আমার পূর্ব বাংলা
যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী।’
১৯৬২ সালে উপলব্ধ তিনটি কবিতায় প্রকাশিত তাঁর এক অপূর্ব ও অভিনব স্বদেশ আমরা প্রত্যক্ষ করি। অল্প পরে ঘটনাপ্রবাহে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির ধারায় মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে নেমে পড়ল সবাই। তাই তিনি লেখেনÑ
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আমি অনবরত কথা বলেছি, বক্তৃতা করেছি। শব্দই ছিল আমার অস্ত্র। এ অস্ত্রের তুলনা হয় না। চিত্তের সব ইচ্ছা এবং বিশ্বাসের সারাৎসার শব্দে সমর্পণ করে আমি আমার দেশের স্বাধীনতাকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলাম।’ (যখন সময় এলো-ঐ)
বস্তুত, সে স্বাধীনতাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। কেননা, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় লাভে রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপট নির্মাণ করল। অনুরাগী অন্নদা শঙ্কর রায় তাঁকে বলে দিয়েছিলেন ‘এখন আপনাদের নিজস্ব সম্পদ অধিগ্রহণ করে সেই সম্পদের সাহায্যে দেশকে গড়তে হবে। ... আমি চাই যে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাজ্য বলিষ্ঠভাবে বেঁচে থাকুক। বর্তমান বিশ্বে বৃহৎ শক্তিবর্গ ক্ষুদ্র দেশগুলোকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে দিতে চায় না। এ পরিস্থিতিতে আপনাদের নিজস্ব শক্তি সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন থাকতে হবে। (ঐ-১৭৮)
নিজস্ব শক্তি সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন সৈয়দ আলী আহসান পূর্বাপর আপন বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে মুক্তিযুদ্ধের মর্মার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। সেজন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিন দশক ধরে। তিনি লক্ষ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ যারা, তারা সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ নির্মাণ করে। তাঁর মতে, ‘প্রত্যেক সংস্কৃতি জাতিসত্তার ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে এবং কতকগুলো অপরিবর্তনীয় মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রত্যেক জাতিই তার সংস্কৃতির মধ্যে পৃথিবীতে তার উপস্থিতিকে সুচিহ্নিত করে। (ঐ-৬১)
বিলাত থেকে আগত ব্রিটিশ শ্রমিক দলের এমপি স্টোন হাউজ তাঁকে বলেছিলেন, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং সত্তার অধিকারী বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। বিপরীত এবং বিরুদ্ধ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কখনোই স্ফুর্তি পাবে না।’ (ঐ-১১১)
মওলানা ভাসানী যে একটি বিস্ময়কর উদার সহনশীলতার মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন, সৈয়দ আলী আহসানেরও সেটিই ছিল অন্বিষ্ট। (ঐ-১১৪)
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের জন্য তাঁর মতে, ‘আমরা কৃতজ্ঞ থাকব, কিন্তু ভারতের সাথে সমপর্যায়ে এবং সমমর্যাদায় অবস্থান করব। এটাই তো চাই।’ (ঐ-১১৬)
মুক্তিযুদ্ধের মর্মার্থরূপে সবচেয়ে বড় যে প্রত্যয় তাঁর মনে জেগেছিল সেটি হচ্ছেÑ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনার সাথে সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে সংযুক্ত করা।’ (ঐ-১২৮)
মুক্তিযুদ্ধে একদা ‘একটি সমগ্র জাতি একাগ্র হয়েছিল একটি পরিবর্তনের জন্য এবং এ পরিবর্তন এসেছিল ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের মাধ্যমে। সাহিত্যের জন্য এটা একটি মহার্ঘ্য চৈতন্য।’ (ঐ-১৩০) জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সৈয়দ সাহেব দুঃখ পেয়েছিলেন এ জন্য যে, আমাদের সাহিত্য যে এর দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রত্যেকেই আপন আপন অভিমান এবং অহমিকার প্রকোষ্ট নির্মাণ করে সেখানেই বসত করছেন।’ (ঐ-১৩২)
ইসলামের অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন নীতিবোধের বিষয়ে তিনি ভারতে সবসময় বক্তব্য প্রদান করেছেন; তাই ‘বাংলাদেশ অঞ্চলে মুসলমানদের নিজস্ব একটা সত্তা আছে এবং সেই সত্তার বিশিষ্টতা নিয়েই যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এ কথা বলতে যে অনেকের দ্বিধা হতো তা তিনি লক্ষ করেছেন।’ (ঐ-১৩৫-১৩৬)
সৈয়দ সাহেবের মতে, ‘মানুষকে মূলত উদার হতে হবে, কল্যাণব্রতী হতে হবে এবং বিশ্বাসী হতে হবে। বিশ্বাস মানুষকে সচলতার পথে অগ্রসর করে এবং ভেদবুদ্ধি মুক্ত করে। ... মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বিশ্বাসই যে তাঁকে প্রেরণা জুুগিয়েছিল। (ঐ-১৪০) সে কথা তিনি একাধিকবার উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement