২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা

-

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন বাঙালির মহত্তম অর্জন। বাঙালির জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী এবং তাৎপর্যবহ। সিপাহি বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ যেমন ভাস্বর হয়ে আছে বাঙালির মানসপটে, তেমনি রয়েছে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শহীদ হন বাংলার দামাল ছেলেরা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন, পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে বহু আত্মত্যাগের ফসল হিসেবে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। আমরা পাইÑ একটি মানচিত্র, একটি দেশ ও একটি পতাকা।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এই লড়াই যেমন ছিল আনন্দের, তেমনি বেদনাবিধুর। বাঙালি জীবনের স্মরণীয়, ত্যাগ ও আলোকিত অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কবিরা কলমকে শাণিত রেখেছেন। দ্রোহ ও ঘৃণায় নরপশুদের কলঙ্কের বিরুদ্ধে কবিরা হাজারো পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। অনেকে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কবি জসীম উদ্দীন তার ‘দগ্ধগ্রাম’ কবিতায় যুদ্ধকালীন বাস্তবতা চিহ্নিত করেছেন এভাবেÑ ‘কী যে কী হইল পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি/সারা গাঁও ভরি আগুনে জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।/মার কোল থেকে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান/পিতার সামনে শিশুরে কাটিল করিল রক্ত স্নান।/কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়, যূপকাষ্ঠের গায়/শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায়। ’
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেই পাকিস্তানি পতাকাকে প্রত্যাখ্যান করে উত্তোলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজ পতাকা। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবিতায় সেই লাল-সবুজ পতাকা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ও স্বপ্নীল সোনার বাংলার প্রতীকÑ ‘আবার বুকের রক্তে বাংলার শ্যামল প্লাবিত,/যেন কোন সবুজাভা নেই আর, সকল সবুজে/ছোপ ছোপ লাল রক্ত, আর সেই/সবুজের বক্ষদীর্ণ রক্তের গোলকে/সোনার বাংলার ছবি/মুহূর্তে পতাকা হয়ে দোদুল বাতাসে।’ (জার্নাল ১ : তেইশে মার্চ ১৯৭১)
পঁচিশে মার্চের কালো রাত সত্ত্বেও ছাব্বিশে মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ আন্দোলন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাতে এগিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে পথে পথে তৈরি হয়েছিল ব্যারিকেড। রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবা থেকে শুরু করে সাধারণ বালকও যুক্ত হয়েছিল সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে। শহীদ কাদরীর কবিতায় তা পেয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনাÑ ‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যত/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করল কয়েকটা অক্ষর/‘স্বা-ধী-ন-তা’।’ (‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’, শহীদ কাদরীর কবিতা)
হত্যা ও ধ্বংসলীলা, মৃত্যুতাড়িত গৃহহারা মানুষের উদ্বাস্তু জীবন, উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রাম-গ্রামান্তরের শূন্যতা ও হাহাকার সেদিন কবির অন্তরে জন্ম দিয়েছিল ক্ষোভ ও ঘৃণার বারুদের। সেই ক্ষোভেরই তীব্র বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতায়Ñ ‘তুমি আমার জলস্থলের/মাদুর থেকে নামো/তুমি বাংলা ছাড়ো।’ (বাংলা ছাড়ো)
শামসুর রাহমান দেখেছেন দখলদার বাহিনীর নির্মম বর্বরতা; দেখেছেন হত্যা ও ধ্বংসের মুখে বিপন্ন মানুষের অসহায় আকুতি। উজাড় হওয়া গ্রাম-গ্রামান্তরের ভয়াবহ শূন্যতার হাহাকার কবিহৃদয়কে করেছে ক্ষত বিক্ষত। সেই দুঃসময়ের অনুভূতিগুলো আভাসিত হয়েছে তাঁর বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থে। কিন্তু কবি জানেন, স্বাধীনতা আমাদের জীবনে এক অনিবার্য ঘটনা। এই অনিবার্যতাকে কবি উচ্চারণ করেন দৃপ্ত প্রত্যয়েÑ ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা)
হুমায়ুন কবিরের কবিতা ‘কারবালা’য় গণমানুষের মানসিকতা ও মুক্তিচেতনার উপস্থাপনা একান্তভাবে এসেছে। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে মুক্তির বাণী, যুদ্ধের কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারবালার সেই যুদ্ধের ভয়াবহতার সাথে মুক্তিযুদ্ধকে তুলনায় এনে কবি বলেছেনÑ ‘কারবালা হয়ে যায় সমস্ত বাংলাদেশ, /হায় কারবালা হয়ে যায়।’
কবি রফিক আজাদের ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’ কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছেÑ ‘তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামি অলঙ্কারে সাজাতে/ভীরু কাপুরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে/ধরতে হল শক্ত হাতে মর্টার, মেশিনগান-/শত্রুর বাংকারে, ছাউনিতে ছুড়তে হলো গ্রেনেড/আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি’। মহাদেব সাহার কবিতায় হৃদয়ের রক্তক্ষরণের আক্ষেপ ফুটে উঠেছে জোরালোভাবেÑ ‘এত হত্যা রক্তপাত আমি থামাতে পারি না’ মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, রক্তস্রোত, স্বজন হারানোর কথায় ব্যথিত চিত্রগুলোয় কবির বিক্ষুব্ধ চিত্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অবলীলায়। যেখানে কবিরা হাজারো প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দেশপ্রেমে আত্মত্যাগের মহিমাকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধজয়ের অপার স্বপ্নকে লালন করেÑ ‘বাঁচাও বাঁচাও বলে এশিয়ার মানচিত্র কাতর/তোমার চিৎকার শুনে দোলে বৃক্ষ নিসর্গ নিয়ন’। এভাবে আল মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্বহারা মানুষের করুণ কান্না ও এশিয়ার মানুষের মধ্যে আন্তরিক সহানুভূতির প্রতিফলনের চিত্র ফুটে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য লোক শহীদ হয়েছে। হারিয়েছে স্বজন। মা হারিয়েছে সন্তান, ভাই হারিয়েছে বোন, সন্তান হারিয়েছে মা-বাবাÑ এ দুঃখ-পরিতাপগুলো আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলো শোকের’ কবিতায় প্রতিফলিত হয়-‘তবে কি আমার ভাই আজ ওই স্বাধীন পতাকা?/তবে কি আমার বোন তিমিরের বেদিতে উৎসব?’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার আবেগ উৎসারিত হয়েছে কবিতায়। তাতে ধ্বনিত হয়েছে কবিদের অনুভব, স্বপ্ন ও অঙ্গীকার। এসব কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে আমাদের জীবনে ও মরণে সঞ্জীবনী অনির্বাণ শিখা। কখনো এসব কবিতায় মূর্ত হয়েছে বাঙালির অপরাজেয় প্রাণ-শক্তি; কখনো কবিতা হয়ে উঠেছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্বপ্ন-সাধের পতাকা। কখনো কবিতায় মূর্ত হয়েছে একাত্তরের কালো রাতের দুঃস্বপ্ন, কখনো তা হয়ে উঠেছে দুর্নিবার সাহস ও বিক্রমের অনন্য বীরত্বগাথা।

একাত্তরের মার্চে হানাদার বাহিনী যে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল দেশকে তাকে শেষ পর্যন্ত ছাপিয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। এই সত্যই কাব্যিক সুষমা পেয়েছে হুমাযুন আজাদের কবিতায়Ñ ‘... সারা বাংলা রক্তে গেছে ভিজে।/ যে-নদীতে ভাসতো রাজহাঁস সেখানে ভাসছে শুধু নিরীহ বাঙালির লাশ।/ সূর্য আর নক্ষত্রের সারাবেলামানুষের, / সেখানে প্রাগৈতিহাসিক পশুরা সে-মানুষ নিয়ে করে বর্বরতা খেলা/তারপর এলো নতুন বন্যা ... সূর্যসংকাশ/ভেসে গেল জন্তুরা, জন্তুদের সকল আভাস।’ (খোকনের সানগ্লাস, অলৌকিক ইস্টিমার)
বাংলা কবিতার পাশাপাশি বিশ্বকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে ভিনদেশীয় কবিদের কবিতায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালান গ্রিন্সবার্গ ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’ শিরোনামের কবিতায় প্রকৃত চিত্র, জনদুর্ভোগের জীবনযাপন উঠে এসেছে দৃঢ় বলিষ্ঠভাবেÑ 'গরষষরড়হং ড়ভ ভধসরষরবং যড়ঢ়বষবংং ধষড়হব/গরষষরড়হং ড়ভ ংড়ঁষং হরহবঃববহ ংবাবহঃু ড়হব/যড়সবষবংং ড়হ ঔবংংড়ৎব ৎড়ধফ ঁহফবৎ মৎবু ংঁহ/অ সরষষরড়হ ধৎব ফবধফ, ঃযব সরষষরড়হ যিড় পধহ/ডধষশ ঃড়ধিৎফ ঈধষপঁঃঃধ ভৎড়স ঊধংঃ চধশরংঃধহ.' অর্থ্যাৎ ‘লক্ষ লক্ষ পরিবার একাকী অসহায়/লক্ষ লক্ষ আত্মা উনিশ শ একাত্তর/যশোর রোডে ঘরহীন উপরে সূর্য ধূসর/দশ লক্ষ মারা গেছে আর যারা পারছে/পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতার দিকে হাঁটছে।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একাত্তরের আগে কবিরা ছিলেন প্রধানত আত্মমগ্ন ও ব্যক্তি অনুভবের বাণীবাহক। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কবির আসনকে সরিয়ে এনেছে জনগণের কাতারে, করেছে সমগ্র জনগণের যন্ত্রণা, প্রত্যাশা ও অঙ্গীকারের সাথে সম্পৃক্ত। এভাবে ব্যক্তির অনুভব ও বোধ একাত্ম হয়েছে সবার অনুভব ও বোধের সাথে। যদিও কবিতায় প্রকাশিত অনুভূতি ব্যক্তি কবির, তবু তা দেশ ও জাতির অনুভবের সাথেই হয়েছে সম্পৃক্ত। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা কেবল সমকালের সঙ্কট ও প্রত্যয়কে তুলে ধরেনি তা বাংলাদেশের কাব্যধারায় নতুন মূল্যবোধকেও সঞ্চারিত করেছে। হ


আরো সংবাদ



premium cement