২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতিতে কবি আল মাহমুদ

-

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ এ জগৎ ছেড়ে পরকালে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে চলে গেলেন। মৃত্যুর খবর শুনে শত শত ভক্ত, অনুরাগী হাসপাতালে ছুটে যান। শেষ বারের মতো একবার দেখার জন্য কেউ হাসপাতালে, কেউ বাসায়, কেউ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কেউ বা বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজায় হাজির হন। আমিও কবিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য, দোয়া প্রার্থনা করার জন্য ছুটে গেলাম বায়তুল মোকাররম জামে মসজিদে জোহর নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ শেষে তার জানাজায় শরিক হলাম। অনেক কবি, সাহিত্যিক, গুণগ্রাহী ওই জানাজায় শরিক হয়েছেন। প্রথম কাতারে নামাজে দাঁড়ানোর কারণে জানাজায়ও প্রথম কাতারে শামিল হওয়ার সুযোগ পেলাম। বিচারপতি আবদুর রউফ, কবি জাকির আবু জাফর, কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি শাহীন রেজা, সাহিত্যিক, শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, কবি কে জি মোস্তফাসহ অনেক গুণী ব্যক্তিকে জানাজায় শরিক হতে দেখলাম। চেনা-অচেনা হাজার হাজার মানুষ কবির নামাজে জানাজায় শরিক হয়েছেন, শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, দোয়া করেছেন।
ছাত্রজীবন থেকে কবি আল মাহমুদকে আমি জানতাম। যৌবনে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাম আন্দোলনে কবি ছিলেন বেশ সক্রিয়। জীবনে পরিবর্তনের বাঁকে নিজেকে খাপ খাইয়ে কবি জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন। কখন যে কবির প্রতি আমার একান্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রখর হয়ে পড়ে তা আমার মনে নেই। কবির লেখা আমি তেমন পড়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আলোচনা, বক্তব্য আমাকে বিভিন্ন সময় মোহিত করে। কবির ব্যবহার, আচরণ, সুবাক্য আমার হৃদয়জুড়ে স্থান দখল যে কখন করে ফেলেছে তা আমি জানি না। কবিকে না দেখলে বা মাঝে মধ্যে কবির সান্নিধ্যে না এলে আমার ভালো লাগত না। তাই যখনই সুযোগ পেতাম কবিকে দেখার জন্য তার ছোট ছোট কিছু কথা শোনার জন্য কবির বাসায় ছুটে যেতাম। কবির জন্ম দিন এলে ফুলের তোড়া নিয়ে বাসায় হাজির হতে খুব ভালো লাগত। যত ব্যস্ততা থাকুক কবির জন্মদিনে ফুল নিয়ে বাসায় ছুটে গেছি। কবিকে ফুল দিয়ে সম্মান জানিয়ে নিজেকে উপলব্ধি করার সুযোগ নিয়েছি। কবি ও আমাকে খুব স্নেহ করতেন, ভালো জানতেন, ভালো বাসতেন। শেষ জন্মদিনে কবির বাসায় জন্মদিনে ফুলের সাথে সামান্য উপহার দিলে কবি খুবই আনন্দিত হলেন। ভালো বাসলেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দোয়া করলেন।
২০১২ সালের কথা। হঠাৎ একদিন মনের মধ্যে জাগল আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিক, লেখকদের সম্মান করা যায় কি না। চালু করা যায় কিনা একটি সাহিত্য পুরস্কার। ২০০৮ সালে আমি আমার প্রকাশনী সংস্থা ‘লেখালেখি’ কার্যক্রম চালু করি। একটি সৃজনশীল প্রকাশনা হিসাবে লেখালেখি ২০০৮ সালে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। কবি আল মাহমুদের ‘আলোক পুলক শিহরণ’ নামে ছোট একটি উপন্যাস আমার প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। কবি-সাহিত্যিক, লেখক, গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য ২০১৩ সাল থেকে ‘লেখালেখি সাহিত্য পুরস্কার’ চালু করা হয়। প্রথম পুরস্কার পান দেশের বরেণ্য কবি আল মাহমুদ। জুরি বোর্ড এক বাক্যে ২০১৩ সালের জন্য কবি আল মাহমুদকে নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের পুরস্কার লাভ করেন কবি আসাদ চৌধুরী এবং ২০১৫ সালের পুরস্কার লাভ করেন কবি আল মুজাহিদী। ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে লেখালেখি সাহিত্য পুরস্কারটি দেয়া হয়নি। দ্রুত সাহিত্য পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।
১৯৭২ সালেই কবিকে আমি চিনি তার সম্পাদিত গণকণ্ঠ পত্রিকার মাধ্যমে। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে গণকণ্ঠের লেখনী কবি আল মাহমুদকে সারা দেশে গণমানুষের কবিতে পরিণত করে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অবস্থায় কবি আল মাহমুদের সম্পাদনায় গণকণ্ঠ পড়ে উৎসাহিত হতাম। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ১৯৭৩ সালে তিনি কারাবরণ করেন। পরে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
কবি আল মাহমুদকে লেখালেখি সাহিত্য পুরস্কার প্রথম দিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত হই। তার হাতে ড. অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ, ড. আকবর আলী খান, কবি কে জি মোস্তফা, কবি আসাদ চৌধুরী, ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী সাহিত্য পুরস্কারের অর্থ পঞ্চাশ হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সম্মাননা তুলে দেন তখন এক অপার আনন্দে আমার হৃদয় আন্দোলিত হয়। মনে হয়েছে সবচেয়ে ভালো কাজটি আমি করতে পেরেছি।
কবি আজ চলে গেছেন। আর দেখা হবে না। কিন্তু হৃদয় দিয়ে কবিকে সব সময় দেখতে পাবো। মনের আয়নায় কবি আমাদের কাছে সব সময় চিরজীবী থাকবেন।
কবির মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ছড়াকার আবিদ আজম আমার অফিসে আসেন। অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে আলাপ হয়। কবির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বলে কবে কবি চলে যাবেন জানি না। তাই খুবই খারাপ লাগে। কবি এখন হাসপাতালে। হঠাৎ কবির লেখা ‘দিনযাপন’ প্রবন্ধের বইটি বের করে দেখিয়ে বললেন দেখুন এই বইটি কবি আপনার নামে উৎসর্গ করেছেন। দেখে আমি অবাক হলাম। কবি আমাকে এত ভালোবাসেন, এত স্নেহ করেন। আমার নামে কবির লেখা বই। চমন প্রকাশ থেকে ২০১৫ সালে প্রবন্ধের বইটি প্রকাশিত হয়।
আল মাহমুদের সাহিত্যের গভীরতা, ভাষাগত সমৃদ্ধি, শব্দের ব্যবহার অতি উঁচুমানের। উঁচু মাত্রার। শব্দ চয়ন অতি অপূর্ব, আকর্ষণীয়, অতি মধুর মাত্রায় গঠিত। তাই তিনি অন্য কবি সাহিত্যিক থেকে অনেক আলাদা।
কবি আল মাহমুদ তার গ্রন্থ ‘দিনযাপনে’ লিখেন, ‘কবির কাজ হলো জগতকে ভাবিয়ে তোলা। মৃত্যু আছে, মৃত্যু বইছে, কিন্তু মৃত্যুর কথা আমরা ভুলে থাকি। কোনটা যে মৃত্যুর জগত তা আমরা ভাবি না। কোথায় যায় মৃতেরা? তারা কি চিরতরে হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়? না কোথাও তাদের জন্য আছে একটা অফুরন্ত অপেক্ষার উপত্যকা। যেখানে আবার দেখা হবে প্রিয়জনের সাথে প্রিয়জনের।
তিনি বলতেন, আমি একজন কবি। কবি হিসেবে আমি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। কবিতার পাশাপাশি কবি আল মাহমুদের কথাসাহিত্যে বেশ দখল ছিল। ১৯৫৪ সালে তার প্রথম গল্প কলকাতার ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কবি চলে গেলেন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল শুক্রবার। যা তিনি কামনা করেছিলেন। কবি এসেছিলেন ১৯৩৬ সালে ১১ জুলাই মোল্লা বাড়িতে। জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আল মাহমুদ তার কবিতায় বেঁচে আছেন থাকবেন। গল্প, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ সব শাখাতে তিনি লিখে গেছেন। কিন্তু কবিতায় তার সৃষ্টি অনবদ্য, অনন্য, অতুলনীয়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলস। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিন। ১৯৭৩ সালে সোনালি কাবিন প্রকাশিত হয়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালি কাবিন একটি ঐতিহাসিক সৃষ্টি। সোনালি কাবিন কাব্যগ্রন্থে কবি আল মাহমুদ লোকজ ও আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে উদ্ভাবন করেন এক ধরনের শব্দ জাদুময়তা।
এই শব্দ জাদুময়তার ভেতর দিয়ে কবি আল মাহমুদ তাঁর পাঠকদের চমকিত করেছেন। সোনালি কাবিন কবি আল মাহমুদকে এনে দিয়েছে তুমুল কবি খ্যাতি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে পৃথিবীর সব বাংলা ভাষীর হৃদয়ে এ কাব্যটি সোনালি হরফে খোদাই করা আছে।
কবি আল মাহমুদের ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনের পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। তখনই তার আদর্শগত চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন আসে। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠাতে তিনি সুমহান আদর্শে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তী জীবনে তার সৃষ্টি প্রহরান্তের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া প্রভৃতি কাব্যে তার আদর্শের চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়। তাঁর আর একটি প্রধানতম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় ভাঙন’। এই কাব্যে কবি আরো বেশি একবার নিজকে পরিবর্তন করেছেন, ভেঙেছেন।
কবি আল মাহমুদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর বিশাল সাহিত্যকর্ম আমাদের হাতের মুঠোয়। তাঁর সৃষ্টি তাঁকে যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি অমর। তিনি আমাদের প্রিয়। তিনি আমাদের হৃদয়ে সব সময় জাগরুক থাকবেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement