২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধ্রুপদী সভ্যতার শহরে সূর্য হাসে

-

লোকটাকে পছন্দ হলো না। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মালদা রেলওয়ে জংশনে এসে ট্রেনটি যখন থামলো তখনই লোকটা ট্রেনে উঠে পড়লো। হাতে কাপড়ের ছোট একটি অনুন্নত ব্যাগ, পরনে হাফপ্যান্ট ও অপেক্ষাকৃত কম দামি টি-শার্ট। বয়স ষাট-বাষট্টি বছর। শরীর ঢিলেঢালা। পেট মেদবহুল ডুঙ্গির মতো গোল যা শরীরের সাথে বেমানান। মুখে খোঁচা খোঁচা আধপাকা দাড়ি। সব মিলিয়ে লোকটাকে শ্রীমান মনে হলো না। তার উপর সে মদ গিলেছে। টলমল পা। টাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। মুখ থেকে কাঁচা মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। গাড়িতে উঠেই সে নিজের সিট খুঁজে নিতে ব্যস্ত হলো। সে যখন সিটটি খুঁজে পেল তখন দেখলো তার সিটে বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া একটি মেয়ে বসে বই পড়ছে। মেয়েটিকে লক্ষ করে লোকটি সিট ছেড়ে দিতে বলল। টু টায়ার সিটের উপরে মেয়েটি উঠে গেলে লোকটি শোয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ভেবে ছিলাম ছাইপাশ গিলা লোকটি বগিতে বসে না জানি কি বকবক করতে থাকে। সেটা সে করলো না। এসি বগি বলে কম্বলমুড়ি দিয়ে লোকটি ঘুমিয়ে পড়লো।
মদপান ও নেশা করা এ দেশে তেমন দোষের নয়। তবে অতিরিক্ত নেশা করাকে মানুষ ঘৃণার চোখেই দেখে। রাস্তার পাশে নেশা অবস্থায় দু’চারজনকে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি যখন দিনাজপুরের হিলি চেকপোস্ট দিয়ে প্রবেশ করে বালুরঘাট রেলস্টেশনে যাচ্ছিলাম তখন নেশায় বুঁদ হয়ে রাস্তার উপর পড়ে থাকতে দেখেছি দু-চারজনকে যা ইন্ডিয়ার মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে আমাকে ভিন্ন রকম ধারণা প্রদান করেছে। বাংলাদেশেও সাঁওতাল, ওরাও, মাহাতো, মাহলি ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকের মধ্যে দু-চারজনকে নেশা করে এভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
আমার গন্তব্য তামিলনাড়– রাজ্যের ভেলুর সিটি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে দূরত্ব প্রায় চার হাজার ১০০ কিলোমিটার। কলকাতার হাওড়া রেলস্টেশন থেকে ভেলুর সিটির কাটপাটি জংশনে পৌঁছে যাওয়া যায় কোনো প্রকার ট্রেন বদল না করেই। সময় লাগে ৩২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা কমবেশি। কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার। ট্রেনের গতি গড় ৪৫ কিলোমিটারের মতো। কিছু ট্রেন সপ্তাহে দু’দিন, কিছু ট্রেন চার দিন, কোনো কোনোটা সপ্তাহে এক দিন আবার কোনো ট্রেন সপ্তাহের প্রতি দিনই যাতায়াত করে। দীর্ঘ সময় ট্রেনে থাকতে হয় জেনে ট্রেন ভ্রমণকে আমলে না নিয়ে যাত্রার দু’মাস পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কলকাতা থেকে চেন্নাই পর্যন্ত বিমানে যাবো।
সেখান থেকে ট্যাক্সি করে ভেলুরে। এতে আমার সময় ও ধকল কমে যাবে কিন্তু খরচের পরিমাণটা বেড়ে যাবে। সেই প্লান মোতাবেক বাংলাদেশ থেকে দু’মাস পূর্বে অনলাইনে বালুরঘাট টু কলকাতা ট্রেনের টিকিট এবং কলকাতা টু চেন্নাই এয়ারের টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। টিকিট করতে গিয়ে মনে হয়েছে ভারতের অনলাইন সেবা খুবই সহজ, স্বচ্ছ এবং সস্তা, এই ধারণাটা বারো দিনের সফর শেষেও আমার একই রকম থেকেছে। বোদাফোনে পঞ্চাশ টাকা রিচার্জ করলে ২৮ দিন মেয়াদের একটি প্যাকেজ পাওয়া যায় যেখানে প্রত্যেক দিন ১.৫ জিবি ডেটা এবং অল ইন্ডিয়া আনলিমিটেড টকটাইম পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এটা ভাবা যায় না।
ভারতে ট্রেন ও বিমান যোগাযোগ বেশ উন্নত। বালুরঘাট থেকে গৌড় এক্সপ্রেস ট্রেনে যখন উঠেছিলাম তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। ট্রেনের সিট খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। দেখলাম প্রত্যেক সিটে একটি কম্বল, একটি বালিশ ও একটি প্যাকেট মতো খাকি রঙের কাগজের বড় খাম স্টেপ্লিং করে রাখা। বুঝতে পারছিলাম না প্যাকেটটি যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত কি না আর এর ভেতরই বা কি রয়েছে। টু টায়ার (দোতলা) এসি কামরার প্রতিটি সিটই স্লিপার। মুখোমুখি উপর-নিচে চারটি আর এক পাশে একটি সিট নিয়ে বড় একটি বগির ভেতরে এ রকম ছোট ছোট ফ্যাট তৈরি করা হয়েছে। খাকি খামের প্যাকেটটি দিয়ে আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আশপাশের যাত্রীদের দিকে ঘন ঘন লক্ষ রাখছিলাম প্যাকেটটি নিয়ে তারা কী করেন সেটি দেখার জন্য। রাত যখন বাইশটা বেজে গেল তখন পাশের সিটে যাত্রীর প্যাকেট খোলা দেখে আমিও আমারটা খুললাম। দেখলাম টানটান করে ক্যালেন্ডার করা সাদা ধবধবে মোটা সুতি কাপড়ের বেডকভার, চাদর এবং একটি পরিষ্কার টাওয়েল, যেন সদ্য লন্ড্রি থেকে এসব ডেলিভারি করানো হয়েছে। এমন পরিষ্কার সাদা কাপড় দেখে মনে হলো রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদেরকে যথেষ্ট সম্মান করে। বাংলাদেশে এমনটা সম্ভব কি না জানি না। বাংলাদেশে রেলের সিডিউল বিপর্যয়ের কথা মনে পড়তেই মনটা ক্ষোভে তেতো হয়ে উঠতে চাইল। সাদা কাপড়ের বেডকভারটি বেডে বিছালাম; অন্যটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
শিয়ালদা স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন সকাল ৭টা। এত বড় স্টেশন আমি এই প্রথম দেখলাম। কুড়ি-বাইশটা তার প্লাটফর্ম। স্টেশনটি প্রথম কার্যক্রম শুরু করা হয় ১৮৬২ সালে। এ দেশে প্রথম রেলের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৩ সালে, তখন ভারতবর্ষের মসনদে ছিল ইংরেজরা।
বাংলাদেশে রেলওয়ে স্থাপন করা হয় ১৮৬২ সালে; দর্শনা ও চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখাতে শিয়ালদা স্টেশনের বর্ণনা পড়েছি এবার স্বচক্ষে সেটি দেখলাম। পৃথিবীর সকল দেশের এয়ারপোর্টে গরিব মানুষদের আনগোনা না থাকলেও বাস ও রেল স্টেশনগুলোতে সব শ্রেণিপেশার মানুষদের আগমন ঘটে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতের রেলস্টেশনে ছিন্নমূল মানুষকে প্লাটফর্মের উপরে শুয়েবসে রাতযাপন করতে দেখা যায়। এসব দেশের জীবনযাত্রার দৃশ্য প্রায় একই রকম। শিয়ালদা স্টেশনেও সেই চিত্র সহসাই চোখে পড়ে। ভেবেছিলাম ভারত উন্নত দেশ; কিন্তু না। যে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত নয় সে দেশের অবকাঠামোর উন্নয়ন আর পারমাণবিক শক্তি দিয়ে কী হয়। সে কারণে অভিজ্ঞতা বলছে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ভারত ছিনিমিনি খেললেও সে দেশের আপামর জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে উঠাতে এখনও তারা পারেনি।
শেয়ালদা স্টেশন থেকে টেক্সি করে দমদম এয়ার পোর্টে যেতে সময় লাগে মাত্র আধা ঘণ্টারও কম। এয়ারপোর্টে ঢুকতে গিয়ে অবাক হলাম। ভাবিনি এত আধুনিক নকশার এয়ারপোর্ট এখানে রয়েছে। বিমানবন্দরটি কলকাতা মেইন শহর থেকে বেশ দূরে। এ এয়ারপোর্ট থেকে ডোমেস্টিক এয়ার প্রত্যেকটা স্টেটের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। স্পাইসিজেট, ইন্ডিগো, ভিস্তারা, ইয়ারজেট, ইন্ডিয়ান ইয়ারওয়েজসহ আরো অনেক বিমান অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করে। দমদম এয়ারপোর্ট এবং চেন্নাই এয়ারপোর্ট দুটিই অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট। বর্ডিংপাস ও যাত্রী সেবার মান সন্তোষজনক মনে হবে। স্মার্ট ওয়াশরুম, করিডোর, ওয়েটিংস্পেস, চেয়ার, লাইটিং সবই দৃষ্টিকাড়া। চেন্নাই এয়ারপোর্টের চেয়ে দমদম এয়ারপোর্ট আয়তনে একটু বড়। গেটআপ ও আউটলুকিং চোখ ধাঁধানো। সুবিস্তর পরিসর। এয়ারপোর্টে আউট এবং ইন করার রাস্তা দৃষ্টিনন্দিত। চেন্নাই এয়ারপোর্ট দমদমের চেয়ে ছোট হলেও সৌন্দর্যে কোনো অংশেই কম নয়। স্পাইসিজেট এয়ারের একটি এয়ারবাসে চেন্নাই পৌঁছলাম দুই ঘণ্টা বিশ মিনিটে। এয়ারপোর্টের এক্সজিট ওয়ে ধরে বের হতে হতে দেখি কড়িডোরের সম্মুখে বিশাল চক্রসংবলিত নটরাজ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। নটরাজ ও গণেশ এ স্টেটের আরাধ্য দেবতা। মূর্তিটি এমন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে যে, এয়ার থেকে যত যাত্রী এক্সজিট করবেন তারা সবাই নটরাজকে না দেখে যেতে পারবেন না।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রথমে ভাষা সমস্যায় পড়লাম। দমদম এয়ারপোর্ট পর্যন্তু বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলেমিশে কাজ চালিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এখানে এসে সে কেরামতি শেষ হলো। টেক্সি ড্রাইভার তামিল ভাষা বলতে ও বুঝতে অভ্যস্ত। ভেলুরে যাওয়ার জন্য টেক্সি খোঁজ করতে লাগলাম। এয়ারপোর্ট থেকে ভেলুরের দূরত্ব প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। বাস, ট্রেন ও ট্যাক্সি এই তিন মাধ্যমেই সেখানে যাওয়া যায়। আমি ট্যাক্সিরই খোঁজ করলাম। কিন্তু টেক্সিওয়ালারা তামিল ভাষা যতটা বোঝে ইংরেজি ও হিন্দি ততটাই না বোঝার চেষ্টা করে। তবে গণিতের সংখ্যাগুলো এক, দো, ছে, চাল্লিস বা ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর এগুলো মোটামুটি সকলেই বুঝতে পারে। এয়ারপোর্টের বাইরে লাইন দিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, জিপ ইত্যাদি। ল্যাগেজসহ বাইরে দাঁড়াতেই দু’জন ড্রাইভার আমাদের দিকে ছুটে এলো। আমাদের বললাম এ জন্য যে, আমি ও আমার স্ত্রী যখন দমদম এয়ারপোর্টে বোডিংপাসের জন্য অপেক্ষা করছি এ সময় বাংলায় কথাবার্তা বলতে দেখে একজন লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি কি না এবং কোথায় যাবো। লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখি তার পাশের সিটে একজন বোরখা পরা স্ত্রী লোকসহ আরো চারজন বসে আমাদের মতোই অপেক্ষা করছে। লোকটি আমাকে বলল সেও বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে এসেছে এবং যে চারজন তার পাশে বসে রয়েছে তারাও নাটোর থেকে এসেছে। এখানেই আমরা পরিচিত হলাম এবং আমরা সবাই একই বিমানের জন্য অপেক্ষা করেছি আর গন্তব্যও সকলেরই ভেলুরের সিএমসি হসপিটালে চিকিৎসা করানো। ড্রাইভার দু’টি সাড়ে চার হাজার রুপি ভাড়া চাইল। ফরিদপুরের লোকটি আমাদের বলল এরা আড়াই-তিন হাজারের নিচে সেখানে যায় না। আমি ড্রাইভারকে বললাম, ইয়ে কেইছে বাত, কেতনা রুপি চাহে। তেন হাজার ইয়ে বহুত রুপি হ্যায়, হ্যাম নেহি দিয়ে গা। ড্রাইভার বলল, ও আদমি ছে পুচকাও, কেতনা রুপি চাহে। এই ড্রাইভারের সাথে কথা না বাড়িয়ে ফরিদপুরের লোকটাকে বললাম, চলুন ট্যাক্সির খোঁজ করা যাক। প্রাইভেট কারের এই দুই ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললাম, কালা ট্যাক্সি কাহাছে মেলেগা? একজন বললো, ও ধারমে তালাশ করো। আমার জীবনে এই প্রথম আমি হিন্দি বলার চেষ্টা করলাম। হিন্দি শুদ্ধ হচ্ছে কি ভুল হচ্ছে জানি না, তবে কি বোঝাতে চাচ্ছি তার সবটাই তো ড্রাইভারটি বুঝতে পারল। আমি আশ্বস্ত হলাম এ রকম হলেই চলবে।
ভেলুর সিটির প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সিএমসি হসপিটাল। আধুনিক চিকিৎসার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় এই পরিচ্ছন্ন হাসপাতালে। হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে নার্সিং কলেজ হিসেবে। আমেরিকান মিশনারির ডা: আইডিএ এস স্কুডার ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে এখানে একটি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই নার্সিং কলেজটি ১৯৪৬ সালে হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৪৮ সালে এই হাসপাতালে পৃথিবীর প্রথম রিকনোস্ট্রাকটিভ সার্জারি ফর ল্যাপ্রোসি বিভাগ চালু হয়। ১৯৬১ সালে ইন্ডিয়ার প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি সার্থকতার সাথে সম্পন্ন করা হয় এখানে। ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়াতে প্রথম কিডনি ট্র্যান্সপ্লান্ট করা হয় এই হাসপাতালেই। ১৯৮৬ প্রথম বোন মেরু ট্র্যান্সপ্লান্টেশান সম্পন্ন করা হয় এই সিএমসি হাসপাতালেই। সে হিসেবে সিএমসির গুরুত্ব খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এসব তথ্য জানা না থাকলেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা নেয়ার জন্য সিএমসিতে আসে। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকেও আসে তবে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ থেকে আগত রোগী তুলনামূলক বেশি। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত এক বছরে ভারত গমন করা বাংলাদেশী প্রায় সাতাত্তর লাখ। এদের কিছুটা ঈদ ও বিয়ের কেনাকাটা আর বাকিটা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আগমন করে থাকে। এখানে আগত রোগীদের জিজ্ঞেস করে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের ডাক্তারদের নৈতিকতা অত্যন্ত দুর্বল। তারা বিনা কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান, আর অকারণেই ওষুধ লেখেন। এমনও দেখা গেছে যে ডাক্তার হয়তো রোগটি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন না অথবা তিনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ রোগী হয়তো সে বিষয়ের রোগী নয় তবুও তিনি রোগীকে অন্য ডাক্তারের কাছে রেফার্ড না করে নিজের কাছে শুধু পয়সার জন্য ধরে রাখার চেষ্টা করেন। অপারেশনের রোগী না হলেও মিথ্যা কথা বলে অপারেশন করানোর ব্যবস্থা করেন। অকারণে রোগীকে আইসিইউতে রেখে দেয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়। ডাক্তারদের এ রকম নানাবিধ প্রতারণার কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা একেবারে উঠে যাচ্ছে। সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে কি না সেটা বুঝে ওঠার আগেই রোগীরা বাংলাদেশে চিকিৎসার প্রতারণা ও চিকিৎসা বাণিজ্যের শিকার হচ্ছে। চিকিৎসার মান যা-ই হোক না কেন বাংলাদেশের মতো চিকিৎসাবাণিজ্য ও প্রতারণার সুযোগ বিদেশে গ্রহণ করা হয় না; সে কারণেই ভেলুরের সিএমসিতে রোগীদের আস্থা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর যন্ত্রপাতি ও টেকনিশিয়ানদের মান নিম্নমুখী। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামেমাত্র টেকনিশিয়ান ও মানহীন যন্ত্রপাতি দিয়ে ডাক্তারদের সুপারিশে ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে। আবার সব ডায়াগনিস্টিক সেন্টার পরিচালিত হয় বাণিজ্যপ্রিয় ডাক্তারদের দ্বারা। সে কারণে অজ্ঞ রোগীদের পকেট কাটতে ডাক্তারদের একটুও বাধে না; তার ওপর সরকার বাহাদুররা নিজেদের চেয়ার সামলানো নিয়ে ব্যস্ত, এসব দেখভাল করা তাদের সময় কোথায়? বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের ডাক্তার ও তাদের আত্মীয়স্বজনের অনেকেই নিজেরাই গোপনে ভিন্ন দেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন সেই সাথে যারা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালনা করেন সেসব কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ সবাই দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসা সেবা নেয়াকে পছন্দ করতে পারেন না। এসব অরাজক অবস্থা দেখেশুনে সাধারণ মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে বিদেশের চিকিৎসালয়ে পাড়ি দিচ্ছেন। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের দেশপ্রেম দিয়ে আমাদের দেশটাকে আমরা সুস্থ রাখতে পারছি না। বাংলাদেশের শিক্ষা ও চিকিৎসা এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের উন্নতি হলে এ দেশের মানুষকে বিদেশের মাটিতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো না। একজন সাংবাদিক চিকিৎসা নিতে ভেলুরের সিএমসিতে এসেছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার চিকিৎসা মান তো প্রায় একই রকম? তিনি বললেন, তবুও ভেলুরই ভালো, কারণ এ দেশের ডাক্তারদের ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। তারা রোগীদের সাথে প্রতারণা ও বাণিজ্যের আশ্রয় নেন না। কথা ঠিক, সে জনই বাংলাদেশের মানুষকে বলা যায় না যে, আপনারা চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন না। বললেও মানুষ আর আমাদের কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না।
খ্রিষ্টানরা কেন ভেলুরে এই বিখ্যাত হাসপাতালটি স্থাপন করলেন তার ইতিহাস অন্য কোনো লেখায় বর্ণনা করার আশা রাখি। তবে ভেলুরের এই হাসপাতালটিকে কেন্দ্র করে এখানে স্বাস্থ্য ও বাণিজ্যনির্ভর জীবন গড়ে উঠেছে। তামিলনাড়– এস্টেটটি ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই এখানকার জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তিত হতে শুরু করে। ভারতের ৩২টি স্টেটের মধ্যে তামিলনাড়–ও বেশ উন্নতই বলা চলে। চেননাই তামিলনাড়–রুর (মাদ্রাজ) রাজধানী। প্রায় ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পূর্বাব্দ থেকে তামিলনাড়–র ভূখণ্ডে তামিলদের বসবাস। দক্ষিণ ভারতের মানব সভ্যতা প্রায় দুই হাজার বছরের সভ্যতা। ভারতের তামিলনাড়–, তেলাঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও কেরালা অঙ্গ রাজ্য এবং লক্ষাদ্বীপ ও পণ্ডিতচেরি প্রশাসনিক এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত দক্ষিণ ভারত। দক্ষিণ ভারত ভৌগোলিকভাবে উপদ্বীপীয় দাক্ষিণাতের মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে আরব সাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। এ অঞ্চলটির ভূমি বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্যময়। এখানে দুটি পর্বতমালা পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট এবং এর মধ্যবর্তী স্থানে একটি মালভূমি রয়েছে। তুঙ্গভদ্র নদী ও কাবেরী নদী এখানকার প্রধান দুটি জলাধার। এখানকার অধিবাসীদের দক্ষিণ ভারতীয় বলা হয়। তারা তামিল, তেলেগু, কন্নড় এবং মালয়ালম এই চারটি দ্রাবিড় ভাষার একটিতে কথা বলে। ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় এ অঞ্চলটিকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজারা শাসন করেছে। এসব রাজার কারো কারো প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও বিস্তারলাভ করেছিল। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডেও দক্ষিণ ভারতের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। এখানে মুসলিমদের শাসনের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা রাজত্ব করে। অর্থনৈতিক অসমতা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য এখানকার বড় সমস্যা। কৃষিকাজ এখানকার রোজগারের পথ হলেও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বেশ উন্নতি লাভ করেছে। এখানকার স্থাপত্যকলা ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় দুই হাজার বছরের ফসল। রাজনীতিতে কেন্দ্রের চেয়ে প্রাদেশিক ছোট ছোট দলের গুরুত্ব অনেক বেশি। তামিলরা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী তবে মুসলিম ও খ্রিষ্টানও রয়েছে। হিন্দু ৮৮, মুসলিম ৬ এবং খ্রিষ্টান ৫.৫ ভাগ। তামিলদের প্রসিদ্ধ নটরাজ স্থাপত্য হিন্দু ধর্মের একটি বিশ্বজনীন প্রতীক। তামিলদের সৃষ্ট প্রাচীন সঙ্গীত ও মন্দির স্থাপত্য আজও অধীত ও অনুশীলীত হয়ে আসছে। এ জন্য তামিল সভ্যতাকে বিশ্বের সর্বশেষ বিদ্যমান ধ্রুপদী সভ্যতা বলা হয়। ইতালি, দোসা তামিলদের প্রধান খাদ্য। ইতালি চালের আটা থেকে তৈরি। মিষ্টি খাবারও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে চলে। ধান, আখ ও নারকেল প্রধান শস্য হলেও ধানের চাষ খুব কম হয়। এমন একটি রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা বাংলাদেশীদের মুগ্ধ করেছে। এখানে চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশীরা হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement