২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাসে লাখপ্রতি ৮০ হাজার টাকা সুদ দেয়ার প্রলোভন : ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ

প্রতীকী ছবি - সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করা গ্রাহকদের প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে নিউ সমিতি নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এতে সমিতির অন্তত দেড় হাজার গ্রাহক পড়েছেন চরম বিপাকে। ঘটনাটি ঘটেছে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ লোকজন ওই সমিতির অফিসের সামনে অবস্থান নিয়েছেন।

এদিকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে কয়েকজন গ্রাহক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে সমিতির নির্বাহী পরিচালক শাহিনুর ইসলাম দরজী ও সহযোগী সাইদুর রহমানকে আটক করেছে দৌলতপুর থানা পুলিশ।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার দৌলতপুর উপজেলার ভররা গ্রামে অবস্থিত এই ‘নিউ সমিতি’ নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো নিবন্ধন নেই। নেই সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া আর্থিক লেনদেনের কোনো অনুমতি পত্র। তারা বেশ কয়েক বছর ধরেই নদী ভাঙন কবলিত ও সহজ-সরল চরাঞ্চলবাসীদের কাছে দাদন ব্যবসা আর চড়া সুদের ব্যবসা করে আসছিল।

এসব কর্মকান্ডের মদদদাতা এক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে মাস চুক্তিতে একটি মোটা অংকের বখশিস নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলার ভররা গ্রামে একটি প্রভাবশালী মহল গড়ে তুলেছে তাদের সুদের সাম্রাজ্য। আর তাদের সুদের বাণিজ্যে সহজ সরল গ্রামবাসী সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ টাকা লাভ করার প্রলোভন দেখিয়ে সহজ সরল এসব মানুষের নিকট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিউ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মোঃ শাহিনুর ইসলাম দরজী, তার মামা কোষাধক্ষ্য সাইদুর রহমান, ম্যানেজার আব্বাস আলী, সহযোগী হৃদয়, আওয়ামী লীগ নেতা ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড সভাপতি মোঃ খলিলুর রহমানসহ আরো অনেকে। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ ওই এলাকায় সুদের ব্যবসা করে আসছে।

প্রায় ১৭ মাস ধরে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা খলসী ইউনিয়নের ভররা গ্রামে নিউ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মোঃ শাহিনুর ইসলাম দরজী (৩৫) গ্রামের সাধারণ মানুষকে উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সমিতির প্রায় কয়েক সহাস্রাধিক সদস্য ও তাদের পরিবার এখন নিঃস্ব।

গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) আসল ও সুদের টাকা না পেয়ে প্রতারণার শিকার লোকজন ও সমিতির সদস্যরা দৌলতপুর উপজেলার ভররা গ্রামে নিউ সমিতির নির্বাহী পরিচালক শাহিনুর ইসলাম দরজী ও সহযোগী সাইদুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে। পরে দৌলতপুর থানা পুলিশ খবর পেয়ে দুই প্রতারককে আটক করে। অভিযুক্ত শাহিনুর ইসলাম দরজী ভররা গ্রামের আরজত আলীর ছেলে ও সাইদুর রহমান একই গ্রামের আতোয়ার রহমানের ছেলে। সমিতির অন্যান্য সহযোগীরা পালিয়ে যায়।

প্রতারণার শিকার ভররা গ্রামের জুলু মল্লিকের ছেলে জামাল মল্লিক জানান, প্রতি মাসে এক লাখ টাকার বিপরীতে ৬০ হাজার টাকা থেকে ৮০ হাজার টাকা সুদ দেবে। আমাকে এই প্রলোভন দেখানোর পর আমি ভররা নিউ সমিতির সদস্য হই। প্রথমে তাদের কেম্পানীতে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করি। পরে আমার ভাইদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে আরো ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন সময় রিসিভের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ১১ লাখ ৮০ টাকা জমা করি। আমি এখন পর্যন্ত সুদের কোনো টাকা পাই নাই। আমার মতো শত শত মানুষ প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

প্রতারণার শিকার ভররা গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে আলতাফ হোসেন জানান, আমার বাড়ির পাশের একজন ঐ নিউ সমিতিতে সদস্য হয়ে, এক লাখে মাসে ৫০ হাজার টাকা লাভ পেয়েছে। আমিও তার কথা শুনে সমিতিতে ভর্তি হয়ে প্রথমে এক লাখ জমা করি। পরে পর্যায়ক্রমে আরো ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা করি। এখন আসল ও সুদের টাকা নিয়ে গড়িমসি শুরু করলে সদস্যরা সবাই মিলিত হয়ে শাহিনুর ইসলাম দরজীর বাড়ি ঘেরাও করে।

প্রতারণার শিকার ভররা গ্রামের নকীমুদ্দিনের ছেলে কাপড় ব্যবসায়ী নুর ইসলাম জানান, তিনি উচ্চ সুদের কথা শুনে ৩ লাখ টাকা রিসিভের মাধ্যমে ওই সমিতিতে জমা করেন। আমাকেও প্রতি মাসে লাখে ৫০ হাজার টাকা হারে সুদ দিয়েছে। প্রতি মাসে যে টাকা পেয়েছি সেই টাকা বাদ দিলে আরো ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাই।

প্রতারণার শিকার ভররা গ্রামের আমোদ আলীর মেয়ে নাসিমা বেগম জানান, আমি চলতি মাসে উচ্চ সুদের আশায় ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে ভররা নিউ সমিতিতে ৪ লাখ টাকা রিসিভের মাধ্যমে জমা দিয়েছি। এভাবে ভররা ও আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে শতশত মানুষ ঐ সমিতিতে কোটি কোটি টাকা জমা করেন। আসল ও সুদের টাকা নিয়ে গড়িমশি করলে সদস্যরা সবাই মিলিত হয়ে শাহিনুর ইসলাম দরজীর বাড়ি ঘেরাও করে।

ভররা এলাকার বিউটি আক্তার জানান, আমাকে ১ লাখ টাকায় ৮০ হাজার করে লাভ দেবে তাই আমি রিসিভের মাধ্যমে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। টাকার কথা আমার স্বামী জানে না।

আটককৃত ভররা নিউ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মোঃ শাহিনুর ইসলাম দরজী ও সহযোগী সাইদুর রহমান জানান, গত ১৬/১৭ মাস পূর্বে ভররা নিউ সমিতি নাম দিয়ে একটি এনজিও করেছি। প্রায় ৫০ জন সদস্য নিয়ে সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করছি। সদস্যদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে এক সদস্যর টাকা আরেক সদস্যদের মাঝে সুদের টাকা হিসেবে দিতাম। সদস্যদের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়েছিল। কিছু টাকা সদস্যদের ফেরৎ দেয়া হয়েছে।
তারা আরো জানান, পুলিশের ভয় দেখিয়ে ভররা গ্রামের জামাই, বরংগাইলের মানু মিয়া এক বস্তায় ১৮ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। সোমবার রাতে আরো ৯০ লাখ টাকা ছালার বস্তায় ভরে বাড়ির পাশে পুকুরের পানির নিচে লুকিয়ে রাখি। লুকিয়ে রাখা সেই টাকার কথা আমার সমিতির ম্যানেজার আব্বাস মিয়া জানতো। পরের দিন (২৩ এপ্রিল) পুকুরে রাখা সেই টাকা নিয়ে আব্বাস উধাও হয়ে গেছে বলে জানান নিউ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মোঃ শাহিনুর ইসলাম দরজী।

এ বিষয়ে দৌলতপুর থানার ওসি সুনীল কুমার কর্মকার জানান, ভররা গ্রামে নিউ সমিতির নির্বাহী পরিচালক শাহিনুর ইসলাম দরজী ও সাইদুর রহমানকে সমিতির সদস্যরা পাওনা টাকার দাবিতে তাকে বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রেখেছে বলে খবর পাই। পরে ভররা এলাকায় ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর প্রতারণার শিকার সমিতির সদস্যদের অভিযোগ শুনে প্রতারক দুই জনকে তাৎক্ষণিক আটক করা হয়।
তিনি আরো বলেন, প্রতারণার শিকার ভররা গ্রামের জুলু মল্লিকের ছেলে জামাল মল্লিক বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছে। মামলা নং-২৩। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।


আরো সংবাদ



premium cement