২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রশিদ খানের হুঙ্কার

রশিদ খানের হুঙ্কার - ছবি : সংগৃহীত

প্রচণ্ড বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল গোটা স্টেডিয়াম। ক্রিকেটারেরা শুয়ে পড়েছিলেন মাঠেই। ধারাভাষ্য দিতে আসা ডিন জোন্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ছুট লাগাবেন বলে। এটা কাবুলে, ২০১৭ সালে, একটি স্থানীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ঘটনা।

এ বছরের শুরুর দিকে আবার জালালাবাদে আত্মঘাতী বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেট দেখতে আসা বেশ কিছু দর্শক। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আফগানিস্তানের সব চেয়ে জনপ্রিয় তারকার প্রিয়তম বন্ধুও।

খেলা চলছে, এমন সময় ক্রিকেটারদের কাছে ফোন চলে আসত। বাড়ি ফিরতে হবে। সন্ত্রাসবাদী হানার শিকার হয়েছেন পরিবারের কেউ। চোখের পানিতে, সাদা পোশাক খুলে বাড়ি ফিরে যেতেন তারা। রক্তাক্ত, ভয়াবহ কোনো ঘটনার সামনে দাঁড়াতে।

কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত, পাহাড়ে ঘেরা দেশটাও সজীব হয়ে ওঠে এক সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির স্পর্শে। সেই জাদুকাঠির নাম ক্রিকেট, সেই জাদুকাঠির নাম রশিদ খান।

এশিয়া কাপে প্রথমে শ্রীলঙ্কা, তার পরে বাংলাদেশকে হারিয়ে হঠাৎ করে ক্রিকেট বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছে আফগানিস্তান। শুক্রবার সকালে কাবুলে ফোন করে পাওয়া গিয়েছিল আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের মার্কেটিং, কমিউনিকেশন এবং মিডিয়া প্রধান স্টানিকজাই লুতফুল্লাকে। বকলমে তিনিই সে দেশের বোর্ডের মুখপাত্র। যার মুখ থেকে শোনা যাচ্ছিল নানা ঘটনার কোলাজ। যে কোলাজে মিলেমিশে গিয়েছিল হিংসা আর ভালোবাসার কাহিনী। যে দেশে স্টেডিয়ামে বোমা বিস্ফোরণ হলে কী হবে, খোলা আকাশের নিচে, রাতের তারাকে সাক্ষী রেখে, কোনো মতে একটা ছোট টিভি জোগাড় করে চলে আফগান পশুপালকদের ক্রিকেট দেখা, সে দেশ তো রূপকথার জন্ম দেবেই। তাই এশিয়া কাপে পর পর শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশকে হারানোর পরে কাবুলে চলছে উৎসব। জাতীয় পতাকা, নায়কদের ছবি নিয়ে বেরোচ্ছে মিছিল।

পাকিস্তান-সীমান্ত ঘেঁষা দেশ বলেই হয়তো ক্রিকেটের প্রতি প্রেম একটু বেশিই আফগানদের। সেই প্রেম এখন অনেক বেড়ে গেছে একটাই কারণে। স্টানিকজাই বলছিলেন, ‘‘আফগান ক্রিকেটের অনেকটাই জুড়ে এখন রশিদ খান। শুরুর দিকে আফগানিস্তানের তরুণ ক্রিকেটারেরা পেস বোলার হতে চাইত। কিন্তু এখন ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। রশিদকে দেখে এখন সবাই ওর মতো স্পিনার হতে চাইছে। আফগান ক্রিকেটকে অনেকটাই বদলে দিয়েছেন রশিদ।’’

যে রশিদ বৃহস্পতিবার নিজের জন্মদিনে একার হাতেই শেষ করে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। দুই উইকেট, হাফসেঞ্চুরি, একটা রান আউট। শোনা গেল, ম্যাচ জিতলেও ড্রেসিংরুমের কেক কাটা ছাড়া বিশেষ কোনো উৎসব করেননি আফগান ক্রিকেটারেরা। তারা এখন বিশ্বাস করেন, এশিয়া কাপটা ঘরে নিয়ে যেতে পারেন। তাই ম্যাচ জিতে নয়, ট্রফি জিতেই উৎসবে ডুবে যেতে চান রশিদরা।

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বিশ্বের অন্যতম সেরা লেগস্পিনার উৎসব না করলে কী হবে, বাকি দলগুলোর উদ্দেশে হুঙ্কার ঠিক দিয়ে রাখছেন। বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমার হাতে কিন্তু এখনো অনেক অস্ত্র আছে। বেশ কয়েক রকম ডেলিভারি আছে, যা আমি নেটে প্র্যাক্টিস করেছি, কিন্তু ম্যাচে এখনো প্রয়োগ করিনি। সময় হলে ওগুলোও হাত থেকে বার করব।’’ এমনিতেই রশিদের লেগস্পিন আর গুগলি বুঝতে বড় সমস্যায় পড়ে যেতে হচ্ছে ব্যাটসম্যানদের। তার ওপর অন্য কোনো ‘ডেলিভারি’ ঝুলি থেকে বার করে আনলে তো কথাই নেই! কিন্তু রশিদের বল বুঝতে এত সমস্যা হচ্ছে কেন? প্রেসবক্সে দাঁড়িয়ে এক সাবেক আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যান বলছিলেন, ‘‘রশিদের আর্ম স্পিডটা এত বেশি, যে বল ছাড়ার সময় কব্জির মোচড়টা কোন দিকে দিচ্ছে, সেটা বোঝা খুবই কঠিন।’’ রশিদ আবার কয়েক দিন আগে বলেছেন, ‘‘আমি শুধু রিস্ট স্পিনারই নই, আমি ফিঙ্গার স্পিনারও।’’ মোদ্দা কথায়, রশিদের দাবি, তিনি কব্জির মোচড়ে তো বটেই, আঙুলের সাহায্যেও বল স্পিন করাতে পারেন। তার নতুন অস্ত্রের পিছনে আঙুলের মাহাত্ম থাকবে কি না, এখন সেটাই দেখার।

জন্মদিনে রশিদ বিশেষ উৎসব-টুৎসব না করলে কী হবে, তাকে ঘিরে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিআইপিদের মাতামাতি কম ছিল না। শচিন টেন্ডুলকর থেকে হরভজন সিংহ। পাকিস্তান থেকে আকমল ভাইয়েরা, ইংল্যান্ড থেকে এক প্রমীলা ক্রিকেটার— সবাই কুড়িতে পা দেয়া রশিদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু শুভেচ্ছার পাশাপাশি চলছে তার বোলিংয়ের রহস্য ভাঙার সব রকম চেষ্টাও।

সব দলের ব্যাটসম্যানরা তো ভিডিয়ো বিশেষজ্ঞ নিয়ে বসে গিয়েছেন, আপনার বোলিংয়ের কাঁটাছেড়া করতে। আপনি কি শঙ্কিত? বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নটা শোনেন ম্যাচের সেরা রশিদ। তার পরে প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভিডিও দেখছে, খুব ভালো কথা। কিন্তু সেটা তো মাঠের বাইরে। মাঠে নামলে ব্যাপারটা অন্য হবে। ব্যাটসম্যানদের চোখে তো আর ক্যামেরা বসানো নেই!’’ রশিদের গলায় দম্ভের চেয়ে আত্মবিশ্বাসের সুরটাই বেশি।

দলের আর এক বিস্ময় স্পিনার, আইপিএল খেলে আসা বছর সতেরোর মুজিব উর রহমানের নামও উঠে আসছে আফগান ক্রিকেটের রূপকথায়। দু’জন তার কথা বলছিলেন। এক জন দীর্ঘদিন ধরে সে দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্টানিকজাই। অন্য জন ভারতের সাবেক ওপেনার লালচাঁদ রাজপুত।

বেশ কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তান ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রাজপুত। কিন্তু ভারতের সাবেক ওপেনার সে দেশে যাননি। কোচিং করিয়েছেন নয়ডা আর দুবাইয়ে বসে। কিন্তু মুজিবকে অল্প বয়সেই দেখেছেন। শুক্রবার রাজপুত বলছিলেন, ‘‘আমি ওকে ছোট অবস্থায় মুম্বইয়ের অনেক ক্লাব ক্রিকেটে খেলিয়েছি। রশিদকেও আমি কোচিং করিয়েছি। ও প্রথম দিকে এতটা বল ঘোরাতে পারত না। তখন বলতাম, তুই স্টাম্প টু স্টাম্প বল করে যা। ব্যাটসম্যান ফস্কালে তুই উইকেট পাবি।’’

আর আফগানিস্তান কী দেখেছিল মুজিবের মধ্যে? ‘‘খুব ছোট থেকেই ছেলেটা প্রতিভাবান। আর আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট পরিকাঠামোর কিন্তু এখন উন্নতি হচ্ছে। এই কাঠামোই তুলে আনছে রশিদ, মুজিবদের মতো ক্রিকেটার,’’ বলছেন স্টানিকজাই।

ক্রিকেট এবং সন্ত্রাস পাশাপাশি ছুটে চলেছে এই দেশটায়। কে শেষ পর্যন্ত ফিনিশিং লাইন টপকে যাবে, তা ঠিক করে দেবে এই রশিদ-মুজিবদের মতো মানুষরাই!

 


আরো সংবাদ



premium cement