২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এনালগ ভালোবাসা চারাগল্প

-

আজ সকাল থেকেই সরব পার্ক।
পার্কের প্রতিটি বেঞ্চে, গাছের নিচে, সরু পথের পাশে, সবুজ ঘাসের ওপর জুটি বেঁধে বসে আছে হাজারো জুটি। তারা গল্প করছে। খুনসুটি করছে। রাগ-অভিমান করছে। পার্কে ঢুকে একটু ডানে গিয়েই সামনে গোলাপ বাগান। গোলাপ বাগানের সামনে ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছের নিচে বেঞ্চ পাতানো। সেই বেঞ্চে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব এক দম্পতি। আলমগীর-আনোয়ারা। তাদের চোখে কালো ফ্রেমের মোটা ভারী চশমা। হাতে চিপসের প্যাকেট। গল্প করছেন আর মুড়মুড় করে চিপস চেবাচ্ছেন।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
প্রতি বছর তারা এই দিনটায় ছুটে আসেন পার্কে। পার্কের নির্মল বাতাসে বসে গল্প করেন। সন্ধ্যা হলে বাসায় ফিরে যান। এই রুটিন তারা চালিয়ে যাচ্ছেন চল্লিশ বছর ধরে। তাদের ভার্সিটিতে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই। আগের দিনে পার্কে এত রূপসজ্জা ছিল না। গাছগাছালি ছিল না। ছিল ফাঁকা ফাঁকা কিছু গাছগাছালি। একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে একটা বেঞ্চ। পার্কের এই ফাঁকা বেঞ্চটাতেই এসে বসতেন আনোয়ারা আর আনোয়ার। তপ্ত রোদে ফর্সা গাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ত আনোয়ারার। মুখের ওপর রুমাল নিয়ে বাতাস করতেন আনোয়ার। একদিন আনোয়ারাকে ঘামতে দেখে বললেন, আনোয়ারা!
রুমাল দিয়ে চিবুকের ঘাম মুছতে মুছতে আনোয়ারা বললেন, বলো।
তুমি ঘেমে গেছো, চলো আমরা একটা গাছের ছায়ায় বসি।
আনোয়ারের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আনোয়ারা বললেন, পুকুর পাড়ে বসে থাকতেই আমার ভালো লাগে।
ঠিক আছে; কিন্তু রোদে তো ঘেমে যাচ্ছ।
যাচ্ছি।
তবু বসে থাকব?
নিজের ভালোলাগাকে উপভোগ করতে গিয়ে যদি এইটুকু কষ্টই সহ্য করতে না পারি, তাহলে জীবন চলার পথে বড় বড় ঝড়গুলো এলে মোকাবেলা করব কিভাবে?
আনোয়ার আর কোনো কথা বলেননি। পরে পার্কের লোকজনকে বলে কয়ে নিজেই সেখানে বেঞ্চের পাশে এই কৃষ্ণচূড়া গাছটি লাগিয়েছেন। গাছটি বছরে বছরে বড় হয়ে এখন চার পাশ স্নিগ্ধ ছায়া দিচ্ছে।
পার্কে এখন অনেক গাছ। প্রতিটি বেঞ্চের ওপর একটি করে গাছ। ছায়ায় ঢাকা থাকে পার্ক। সারাক্ষণ হু হু করে বাতাস বয়ে চলে। যেকোনো বেঞ্চে বসলেই ঝিরিঝিরি বাতাসে গা জুড়িয়ে যায় পথিকের।
তাদের বেঞ্চের ডান পাশে এ বছর আরো একটা নতুন বেঞ্চ বসানো হয়েছে। আলমগীর মোটা ফ্রেমের চশমার নিচ দিয়ে খেয়াল করলেন, সকাল থেকে অলরেডি দুইটা জুটি পাশের বেঞ্চে বসে ঝগড়া করে তাদের সম্পর্ক ব্রেকআপ করল। এখন বসে আছে তৃতীয় জুটি। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের মধ্যেও ঝগড়া বেঁধে গেল। মেয়েটি বসা থেকে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, তুমি আমাকে ঠকিয়েছ, মিথ্যা বলে আমার সাথে প্রতারণা করেছ।
ছেলেটি হাতজোড় করে বলছে, হ্যাঁ মিলি, আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি শুধু তোমাকে পাওয়ার জন্যই মিথ্যে বলেছি।
মেয়েটি চোয়াল শক্ত করে বলে, আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করি না, আবির। তুমি একটা প্রতারক, মিথ্যুক।
আমার কথাটা একবার শোনো, প্লিজ !
আমি আর তোমার কোনো কথাই শুনতে চাই না।
শুধু একটা, শুধু একটা কথা শোনো, প্লিজ।
মেয়েটি চোখ বন্ধ করে, চোয়াল শক্ত করে বলল, আ-বি-র!
হুম।
তুমি কি আমাকে ভালোবাস?
খুউব।
আমি একটা কথা বলব, শুনবে?
হুম, বলো।
তুমি যদি আমাকে এতটুকু ভালোবাস, তাহলে আমার সামনে থেকে সরে যাও, প্লিজ!
আবির হতভম্ব। আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বেঞ্চ থেকে উঠে ধীরে ধীরে চলে গেল।
ধপ করে বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল মেয়েটি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
আনোয়ারা উঠে মেয়েটির কাছে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কী হয়েছে দাদুভাই, আজ এত সুন্দর একটা দিনে তুমি কাঁদছ কেন?
ও আমাকে ঠকিয়েছে।
কে ঠকিয়েছে?
আবির।
আবির কে?
যে চলে গেল। সে ছিল আমার ফেসবুক বন্ধু। একদিন সে আমাকে বলল, মিলি, আমি সচিবালয়ে চাকরি করি। তোমাকে খুব ভালো লাগে আমার। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমি তার সহজ কথায় বিশ্বাস করেছিলাম। বিশ্বাস করে তাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আজ জানলাম, সে কোনো চাকরি করে না, ভবঘুরে। বেকার। আমাকে মিথ্যা বলেছে। মিথ্যা বলে ঠকিয়েছে। বলে আবারো হু হু করে কাঁদতে লাগল মেয়েটি।
আনোয়ারা বললেন, কেঁদো না দিদিভাই। নেটে, ফেসবুকে ওসব ডিজিটাল প্রেম করতে নেই। অপরিচিত কাউকে না জেনে ভালোবাসতে নেই। ওসব নেটের প্রেমের কোনো ভিত্তি নেই। ঠুনকো। বালির বাঁধ। তুমি যাকে ভালোবাসবে, এনালগ ভালোবাসবে। যাকে ভালোবাসবে তাকে আগে ভালো করে চিনবে, জানবে, বুঝবে। ম্যাসেঞ্জার, ইমু, টুইটারে নয়, তাকে চিঠি লিখবে হলুদ খামে। দেখবে সত্যিকারের ভালোবাসা তুমি উপভোগ করছ। আজ থেকে চল্লিশ বছর ধরে এই বেঞ্চে বসে তোমার দাদু আর আমি এনালগ প্রেম করছি, আজ অবধি আমাদের মাঝে কোনো দিন ভুল বুঝাবুঝি হয়নি।
মিলি উঠে জড়িয়ে ধরল আনোয়ারাকে। আমিও তোমার মতোই এনালগ প্রেম করতে চাই দাদি। যেখানে থাকবে না কোনো মিথ্যা আশ্বাস, প্রতারণার বেড়াজাল। শুধু থাকবে বিশ্বাস, আর ভালোবাসাবাসি।
সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর।


আরো সংবাদ



premium cement