২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হেমন্তের এই দিনে

-

 

সেদিন ছিল হেমন্তের সকাল। সোনালি মাঠের ওপর পড়ছিল সকালের নরম হলুদ রোদ। চারদিকে দুলছিল মাঠের সোনালি ধানের শীষ। আমি হাঁটছিলাম সোনালি মাঠের আইল ধরে। পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল ভোরের শিশির। মাথার ওপর ভালোবাসার বৃত্ত এঁকে উড়ে যাচ্ছিল একঝাঁক পাখি। 

এ সময় সেলিম কাকা চাদরের কোনায় এককোচা মুড়ি নিয়ে মুখে পুরতে পুরতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছিলেন মাঠের দিকে। আমাকে দেখেই হাঁক দিলেন, এই বাতেন, তুই এ দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, আমি কখন থেকে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

কেন কাকা? কী হয়েছে?

তোর বাবার অবস্থা ভালো না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। 

আমি দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে।

বাড়িতে গিয়ে দেখি উঠোন ভর্তি লোক। বাবা বারান্দায় শুয়ে আছেন। দুই হাতে বুক চেপে ধরে ছটফট করছেন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। বুক থেকে গোঙানির মতো শব্দ বের হচ্ছে। আকস্মিক এই পরিস্থিতিতে আমি হতভম্ব। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 

কয়েক দিন থেকে বাবার গায়ে জ্বর ছিল। বাজারের হাতুড়ি ডাক্তারের কাছে ওষুধ খেয়ে জ্বর সেরেও গিয়েছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ কী হলো?

বাবা আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। বললেন, বাবা, আমার কলিজা পুড়ে যাচ্ছে। আমি বুঝি আর বাঁচব না। আমাকে একটু নয়া ধানের ভাত আর টেংরা মাছের ঝোল দিতে পারবে? খেতে খুব ইচ্ছে করছে। 

আমি পড়লাম বিপাকে। 

মাঠে ধান পেকেছে; কিন্তু এখনো সেই ধান কেটে ঘরে তোলা হয়নি। বাজার অনেক দূরে। তা ছাড়া এত সকালে বাজারও বসেনি। আমি এখন নতুন ধানের চাল আর টেংরা মাছ পাই কোথায়? কী করি?

সবাই পরামর্শ দিলেন, তুমি আগে তোমার বাবাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাও। পরে সব কিছু খাওয়ানো যাবে। 

নব্বই দশকের কথা। তখন রাস্তাঘাট এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। শহর থেকে বাড়ি অবধি কাঁচা রাস্তা। রাস্তা খানাখন্দে ভরা। গ্রামের যানবাহন বলতে ছিল শুধু ভ্যানগাড়ি।

আমি বাবাকে ভ্যানগাড়িতে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালের দিকে। খানাখন্দে ভরা রাস্তা। ভ্যানগাড়ি এগোতে পারে না। খানাখন্দে আটকে যায়। তবুও আমরা বাজপাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ভ্যানগাড়ি নিয়ে যেতে লাগলাম। শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে এলো। হাসপাতালে পৌঁছলে ডাক্তার ঘোষণা দিলেন, বাবা নেই।

ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।

ডাক্তার বললেন, হাতুড়ে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেছেন। 

আজো প্রতি বছর হেমন্ত এলে মনে পড়ে বাবার কথা। হেমন্তের নতুন ধানের ভাত মুখে তুলতেই মনে পড়ে বাবার কথা। বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল হেমন্তের নতুন ধানের ভাতের সাথে টেংরা মাছের ঝোল খাওয়ার। কিন্তু আমি বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি। ব্যর্থ আমি।

ধরে আসে গলা। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে টপটপ করে অশ্রুধারা।

সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

 


আরো সংবাদ



premium cement