জলবায়ু পরিবর্তন: বড় বন্যার আশঙ্কা ও প্রস্তুতি
- সাধন সরকার
- ১৭ জুলাই ২০১৮, ০০:০০
এ বছর বড় ধরনের বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার, ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। বলতে গেলে পুরো বৈশাখে এবার প্রকৃতির আচরণ ছিল এলোমেলো। কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতে বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এখন আউশ ও আমনের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়াবিদদের গবেষণা মতেÑ এ বছর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতসহ চীন, নেপাল এবং ভারত হয়ে পাহাড়ি ঢল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। বন্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতিবৃষ্টি এবং উজানে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও গঙ্গা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বন্যায়ও বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যা প্রাকৃতিক হলেও এর ক্ষতির জন্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যকলাপ এবং সেই সাথে, সার্বিক প্রস্তুতির ঘাটতিও কম দায়ী নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে অস্বাভাবিক মাত্রায় বিভিন্ন দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ ভারী বর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের বা যেসব দেশের কোনো ভূমিকা নেই, সেসব দেশের মানুষ বা দেশকে কেন জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ভুগতে হবে? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, মাত্র ০.৩ শতাংশ কার্বন নির্গমন করে বাংলাদেশ। বিশ^কে বাসযোগ্য করার দায় উপেক্ষা করে উন্নত রাষ্ট্রগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিগর্মন করে চলেছে। তাই বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত রাষ্ট্রগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে জোর তৎপরতা চালাতে হবে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে মূলত বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যা একটি প্রাকৃতিক বাস্তবতা এবং ভাটির দেশ হিসেবে অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ দিয়েই নেমে থাকে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদ-নদী দখলসহ নাব্য কমে যাওয়ার ফলে অতিবৃষ্টির পানিপ্রবাহ বিঘিœত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মওসুমি বায়ুপ্রবাহ হয়ে যায় এলোমেলো। মওসুমি বায়ু যতই বিস্তৃত হয়, ততই বাড়ে বৃষ্টিপাতের আওতাধীন অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বার্ষিক বৃষ্টি দিনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যাচ্ছে। অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত অনিয়ন্ত্রিত বন্যায় রূপ নিচ্ছে। ভারতের পানিনীতিও বাংলাদেশে বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। উজানে শুষ্ক মওসুমে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখা এবং বর্ষা মওসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। প্রতি বছর বন্যাকালীন জানমাল ও সার্বিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যার সময় জানমালসহ ব্যাপক ক্ষতি মোকাবেলায় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও সমাধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে বন্যার আগে, বন্যাকালীন ও বন্যাপরবর্তী এলাকাভিত্তিক সার্বিক ক্ষতি, বন্যার তীব্রতা, ত্রাণ তৎপরতা, পুনর্বাসন, কৃষি সহায়তাসহ দরকারি সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাড়াতে হবে নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা। এ ছাড়া রোহিঙ্গা বসতি এলাকায় বন্যা মোকাবেলায় সতর্ক থাকতে হবে। বন্যার সময় সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নানা দিক বিবেচনায় রেখে বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। বন্যাকালীন খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি রাখতে হবে। মূলত গত বছর হাওর অঞ্চলসহ দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক বন্যায় জানমাল ও অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ দরিদ্র মানুষের খাদ্য পাওয়ার সুযোগ বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। এ সময় ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। তাই বন্যার মতো দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো মহল যাতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে না পারে, সে দিকে নজর রাখতে হবে।
ত্রাণতৎপরতাসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা, তাৎক্ষণিকভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া, পুনর্বাসন কর্মসূচি ও কৃষকদের সহায়তা প্রভৃতির পরিকল্পনা এখন থেকেই নেয়া উচিত। বন্যাকালীন ও বন্যাপরবর্তী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়েও পরিকল্পনা জরুরি। এ দুর্যোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এবং ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার পথ খুঁজতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বন্যা মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে। বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে। হ
লেখক : সাবেক ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
sadonsarker2005@gmail.com