৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নির্বাচনে হেরে বিশ্বরেকর্ড গড়তে চান যে ভারতীয়

প্রতিবার ভোটে হেরেও যিনি ‘ইলেকশন কিং’ নামে পরিচিত। - বিবিসি

ভারতে নির্বাচনকে দেখা হয় গণতন্ত্রের মহাপর্ব হিসেবে। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা প্রার্থীদের মধ্যে কেউ সেলিব্রিটি মানে তারকা আর কেউবা সাধারণ মানুষ।

প্রচার, বর্ণাঢ্য সমাবেশ, মঞ্চ থেকে দেয়া উস্কানিমূলক বক্তৃতা, পোস্টার, ব্যানার, পতাকা, রোড শো- এই সব মিলিয়ে নির্বাচনি ময়দানে উত্তেজনার পারদ চড়তেই থাকে। প্রত্যেক প্রার্থীই মাঠে নামেন ভোটে জিততে।

তবে ভারতের তামিলনাড়ুর সালেম জেলার মেত্তুরের বাসিন্দা কে পদ্মরাজনের লক্ষ্য আলাদা। তিনি ভোটে লড়েন ‘হারার’ উদ্দেশ্যে। মোটেই অবাক হবেন না। সত্যি কিন্তু এটাই।

১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩৯টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কে পদ্মরাজন, যিনি ‘ইলেকশন কিং’ নামে পরিচিত।

পেশায় সাইকেল মেরামতের দোকানের এই মালিক লড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও, তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে।

আসন্ন লোকসভা ভোটেও দাঁড়িয়েছেন তিনি।

কয়টি রাজ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন পদ্মরাজন?

এখনো পর্যন্ত কে পদ্মরাজন ভারতের ১২টি রাজ্যের বিভিন্ন আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বিধানসভা, সংসদ নির্বাচন এবং এমনকি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচনও এই তালিকায় রয়েছে।

উল্লেখ্য, ভারতের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো জায়গা থেকে ভোটে লড়তে পারেন। এর জন্য তাকে হলফনামা দাখিল করতে হবে।

কে পদ্মরাজন বলেন, 'সত্যি বলতে, আমার লক্ষ্য আরো বেশি নির্বাচনে হারা।'

বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু এটাই তার ইচ্ছা। এবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ‘ইলেকশন কিং’ নামে পরিচিত পদ্মরাজন ভোটে লড়ার বিষয়ে কীভাবে আগ্রহী হলেন?

স্কুলের পড়া শেষ করার আগে থেকেই সাইকেল মেরামতের কাজ শুরু করেন তিনি।

‘ডিস্টেন্স এডুকেশনের’ মাধ্যমে ইতিহাসে স্নাতকের ডিগ্রি লাভ করার পরেও কে পদ্মরাজনের মূল পেশা কিন্তু এখনো সেই সাইকেল মেরামতই।

ভোটে লড়ার টাকা কোথা থেকে আসে?

২৩৯টি নির্বাচন লড়ার জন্য অর্থ কোথা থেকে এসেছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে পদ্মরাজন জানিয়েছেন কষ্টার্জিত কোটি টাকা খরচ হয়েছে ভোটে লড়তে।

কেন নির্বাচনি প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাধ হলো সে বিষয়ে তিনি বলেছেন, 'সাইকেলের দোকানে বসে একদিন হঠাৎই একদিন আমার ভোটে লড়াই করার ইচ্ছে হলো। সেটা ১৯৮৮ সালের কথা। তারপর আমার পুরো জীবনই বদলে যায়।'

তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছে জানতে পেরে বন্ধুরা মস্করা করেন। একজন সাইকেল মেরামতের দোকানের মালিক কীভাবে ভোটে লড়বেন সে নিয়ে তাকে কথাও শুনতে হয়েছিল। আর ঠিক এই কারণেই এখনো পর্যন্ত ২৩৯টি নির্বাচনে লড়ছেন তিনি।

পরিবারের সদস্যরাও কী তার এই জেদকে সমর্থন করেন? এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, 'প্রথম প্রথম বিরোধিতা করেছেন বটে, কিন্তু এখন আমার কথা বুঝতে পারেন তারা।'

কে পদ্মরাজনের ছেলে শ্রীজেশ এমবিএ করেছেন। বাবার জেদের বিষয়ে তিনি বলেন, 'ছেলেবেলায় যখন লেখাপড়া করতাম তখন বাবার ওপর রাগ হতো। আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম উনি কী করছেন। এখন বড় হয়ে বুঝতে পারি বাবার লক্ষ্য কী?'

'যে কেউ নির্বাচনে লড়তে পারেন এই বার্তা তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চান। তারপর থেকে আমি সব সময় বাবাকে সমর্থন করে এসেছি।'

যাদের বিরুদ্ধে ভোটে লড়েছেন

টানা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে কে পদ্মরাজন এবং তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

কে পদ্মরাজনের দাবি, ১৯৯১ সালে উপনির্বাচনে অন্ধ্রপ্রদেশের নন্দিয়াল থেকে পিভি নরসিমা রাওয়ের বিরুদ্ধে মনোনয়ন জমা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু লোক তাকে অপহরণ করে।

অপহরণকারীদের খপ্পর থেকে কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। তবে এই ঘটনা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছায় কোনো প্রভাব ফেলেনি বলে দাবি করেছেন পদ্মরাজন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ছাড়াও পদ্মরাজন ২০০৪ সালে লক্ষ্ণৌ থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ী, ২০০৭ ও ২০১৩ সালে অসম থেকে মনমোহন সিং এবং ২০১৪ সালে ভদোদরা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

শুধু তাই নয়, তিনি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন, আবদুল কালাম, প্রতিভা পাতিল, প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং রামনাথ কোবিন্দের পাশাপাশি বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বিরুদ্ধেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

তামিলনাড়ুতে কে করুণানিধি, জে জয়ললিতা, এম কে স্ট্যালিন এবং ই কে পালানিস্বামী, কর্ণাটকে সিদ্দারামাইয়া, বাসবরাজ বোম্মাই, কুমারস্বামী এবং ইয়েদুরাপ্পা, কেরালায় পিনারাই বিজয়ন এবং তেলেঙ্গানায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মতো মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ভোটে।

যে কেন্দ্রে থেকে তিনি ভোট লড়েন, সেখানে প্রচার করেন কি না সে কথা জিজ্ঞাসা করা হলে কে পদ্মরাজন জানান, তিনি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিলেও নির্বাচনি প্রচার করেন না।

শুধুমাত্র মনোনয়ন দেয়ার জন্যই খ্যাত এই ব্যক্তি কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন। তিনি ২০১৯ সালে কেরালার ওয়ানাড় কেন্দ্রে তিনি রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তার ঝুলিতে এসেছিল ১ হাজার ৮৮৭টি ভোট।

তবে এমনও হয়েছে যে ভোটে দাঁড়িয়ে তার নিজের ওয়ার্ডে একটা ভোটও পাননি পদ্মরাজন। আবার ২০১১ সালে মেত্তুর বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬ হাজার ২৭৩ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। আজ পর্যন্ত যে কয়টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি তাতে এটিই তার ঝুলিতে থাকা সর্বোচ্চ ভোট।

কে পদ্মরাজনের নীতি কিন্তু একেবারে ‘অন্য’। ভোটে হেরে যাওয়াই তার নীতি। এই কারণে, পদ্মরাজনের নাম লিমকা বুক অফ রেকর্ড-এ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী হিসাবে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।

তবে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নিজের নাম দেখতে চান তিনি। এই রেকর্ড রয়েছে অন্য এক ভারতীয়র ঝুলিতে। কে পদ্মরাজনের আগে কাকা যোগিন্দর সিং ধরতিও ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

‘ধরতি পকড়’ নামে পরিচিত কাকা যোগিন্দর সিং ১৯৬২ সাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে যখন তার মৃত্যু হয় ততদিনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ফেলেছিলেন প্রায় ৩০০টি নির্বাচনে। তিনি স্থানীয় পর্যায় থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

তিনিও ভোটে হারার উদ্দেশ্যেই লড়তেন যদিও অংশ গ্রহণ করতেন নির্বাচনি প্রচারে। তার প্রচার ছিল অন্যরকম। নির্বাচনি এলাকায় প্রচার করে তাকে ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের কাছে আবেদন করতেন কাকা যোগিন্দর সিং।

ফিরে আসা যাক কে পদ্মরজানের কথায় যিনি এইবার তামিলনাড়ুর ধর্মপুরী আসন থেকে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। অন্যান্য বারের মতো এইবারো ‘পরাজয়ই’ যে তার জন্য অপেক্ষা করছে সে বিষয়ে নিশ্চিত তিনি। কিন্তু ‘ধরতি পকড়’-এর ঝুলিতে থাকা ৩০০টা নির্বাচনের রেকর্ডকে ভাঙতে বদ্ধপরিকর এই ‘ইলেকশান কিং’।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement