২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভারতের একজন মন্ত্রী কেন নাগরিকত্বের আবেদন করতে চাচ্ছেন

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের (ডানদিকে) সাথে মতুয়া নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর (বাঁয়ে) - ছবি - বিবিসি

বিজেপির সংসদ সদস্য ও ভারতের জাহাজ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলছেন যে তিনিও সেদেশের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করবেন।

গত সপ্তাহে চালু হওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব দেয়ার আইন।

শান্তনু ঠাকুর যে মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা, তারা পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ। কিন্তু শান্তনু ঠাকুর নিজে বলছেন যে তিনি এমন কী তার বাবা-মায়েরও জন্ম ভারতেই।

তবে তার ঠাকুমা পূর্ব বঙ্গ থেকে ভারতে এসে নথিবদ্ধ করার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিক হয়েছিলেন।

সেকারণে তিনি ভারতেরই নাগরিক।

বাংলাদেশী অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার আইন অনুযায়ী কেন আবারো তিনি নাগরিকত্বের আবেদন করার কথা ভাবছেন?

‘সাহস যোগানোর জন্য আবেদন’
বিবিসি বাংলাকে শান্তনু ঠাকুর বলছিলেন, ‘এটা ঠিকই আমি, আমার মা-বাবা সবাই ভারতের নাগরিক। তবুও আমি সিএএ অনুযায়ী আবেদন করার পরিকল্পনা করেছি, যাতে আমার সমাজে সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে এই আইন অনুযায়ী আবেদন করেন। তাদের সাহস যোগানোর জন্য আবেদন করব আমি।’

তিনি আরো বলছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এবং তৃণমূল কংগ্রেস দল বার বার বলছে সিএএ অনুযায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করলেই সব সরকারি সুযোগ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে, নাগরিকত্ব হারাতে হবে।

‘মুখ্যমন্ত্রী যে অহেতুক ভয় দেখাচ্ছেন, সেটা প্রমাণ করারও একটা দায়িত্ব আছে আমার। আমি নাগরিকত্বের আবেদন করার পরে দেখি কেমন করে সব সরকারি সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়, দেখি আমাকে বে-নাগরিক করে দেয়া হয় কী না। ওরা ভুল বোঝাচ্ছে মানুষকে,’ বলছিলেন শান্তনু ঠাকুর।

মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষরা পূর্ব পাকিস্তান বা পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এলেও তারা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সমর্থন করেছেন।

ভারতীয়রা কি আবেদন করতে পারবে?
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপির সংসদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও শান্তনু ঠাকুর কী করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

মতুয়াদেরই একটা অংশের নেতা ও লেখক সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলছিলেন, ‘আমি ওদের পরিবারকে বহুদিন ধরে চিনি। ওর জন্ম তো এদেশে। সে কী করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবে? এই আইনে তো সেই সুযোগই নেই।’

‘আইনের গোড়াতেই বলা আছে যারা নাগরিক নয়, তারাই একমাত্র নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। যদি তারা আবেদন করেন, তাহলে তো তাকে বলতে হবে তার জন্ম বাংলাদেশে। এফিডেফিটও জমা দিতে হবে যে যা বলছি সত্য বলছি। এফিডেফিটে যদি অসত্য বলা হয়, সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই তিনি আবেদন করতে পারেন না,’ বলছিলেন সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস।

মতুয়াদের উদ্বেগ
মতুয়াদের একটা অংশ বিজেপি সমর্থক এবং আরেকটি অংশ তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করেন।

পূর্ব বঙ্গ এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতে চলে আসা উদ্বাস্তু এবং মতুয়াদের প্রায় দুই কোটি মানুষ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের নাগরিকত্ব পাননি। তবে উদ্বাস্তু এবং মতুয়া নেতারাই স্বীকার করেন যে প্রায় সকলেই কোনো না কোনোভাবে ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার কার্ড ইত্যাদি যোগাড় করে নিয়েছেন।

কিন্তু আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবি তারা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছিলেন। তাই ভারতের বহু মানুষ, এবং অ-বিজেপি দলগুলো সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করলেও মতুয়াদের বড় অংশই সিএএ চাইতেন।

তবে তারা চেয়েছিলেন নিঃশর্ত নাগরিকত্ব।

এখন অবশ্য নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য কয়েকটি শর্ত আরোপ করায় তারা আবারো দ্বিধায় পড়েছেন যে নতুন আইনেও কী তারা নাগরিকত্ব পাবেন?

যে দেশ থেকে তারা ভারতে এসেছেন, সেখানকার কোনো একটা নথি দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি আসলেই ওই তিন দেশের কোনো একটির নাগরিক ছিলেন।

মতুয়াদের একটা অংশ বলছেন, যারা পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছেন, তাদের কাছে কী নথি থাকতে পারে সেদেশের!

যদিও মতুয়াদের একটা অংশের মধ্যে উচ্ছ্বাস রয়েছে সিএএ নিয়ে।

মতুয়া কার্ড
সিএএ চালু হওয়ার পর থেকে মতুয়া মহাসংঘের সদস্য কার্ড নেয়ার জন্য প্রচুর ভিড় হচ্ছে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ঠাকুরনগরে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্রে।

ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা কথা ছড়িয়েছে যে মহাসংঘের কার্ড থাকলে তারা নাগরিকত্ব পাবেন।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও বলেছেন সেকথা।

তিনি বলছিলেন, ‘কারো যদি কোনো নথি না থাকে তবে সেক্ষেত্রে সেলফ ডিক্লারেশন দিতে হবে। আমি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে বলছি আপনারা মতুয়া কার্ড করুন। এই কার্ড থাকেলে আপনি সংগঠনের একজন সদস্য। আপনার নাগরিকত্ব কেউ আটকাতে পারবে না।’

তবে মতুয়া মহাসংঘের সদস্য বৃদ্ধি তাদের উদ্দেশ্য নয়, এটাও বলেছেন তিনি।

অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মমতা বালা ঠাকুর বলছেন, ‘মতুয়া কার্ড থাকলেই যে নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কি কিছু বলেছে? শান্তনু ঠাকুর মানুষকে ভাঁওতা দিচ্ছেন। আসলে কার্ড তৈরি করে নিজেদের আয় বাড়াচ্ছেন।’

মতুয়া কারা?
মতুয়ারা আসলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নমঃশূদ্র গোষ্ঠীর মানুষ।

বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুর এই সম্প্রদায়ের সূচনা করেন।

ভারতের স্বাধীনতার পরে তারা নিজেদের বড় সংখ্যক শিষ্যদের নিয়ে ভারতে চলে আসেন এবং উত্তর ২৪ পরগণার ঠাকুরনগরে নিজেদের ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

মতুয়া সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মগুরুরা স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। এক সময়ের সঙ্ঘাধিপতি প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর ছিলেন কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য। তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতিরাও সক্রিয় রাজনীতিতে রয়েছেন।

একটা সময়ে এই মতুয়ারা প্রায় সবাই ভোট দিতেন বামফ্রন্টকে। ২০১১ সাল থেকে তারা ভোট দিতে শুরু করলেন তৃণমূল কংগ্রেসকে।

আর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া মহাসংঘে চিড় ধরে, একটা অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে, যার নেতৃত্বে আছেন দলটির রাজ্যসভার সংসদ সদস্য মমতাবালা ঠাকুর আর অন্য অংশটির প্রধান শান্তনু ঠাকুর বিজেপির টিকিটে জিতে সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে মতুয়াদের তীর্থস্থান বলে পরিচিত গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে একটি মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement