১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫
`


দূরদর্শনের লোগোর রং বদলে ‘গেরুয়া’ করা নিয়ে বিতর্ক

দূরদর্শনের লোগোর পরিবর্তনকে ঘিরে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। - ছবি : বিবিসি

ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচার সংস্থা প্রসার ভারতী তার চ্যানেল ‘ডিডি নিউজ’-এর লোগো লাল থেকে ‘গেরুয়া’ করে দিয়েছে। লোকসভা ভোটের সময় দূরদর্শনের এই লোগোর রং বদলকে ঘিরে তীব্র সমালোচনায় সরব হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

তাদের দাবি গেরুয়া করার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে এবং বিরোধীদের সেই অভিযোগের নিশানার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি।

এই ঘটনার সমালোচনা করেছেন রাজ্যসভার সাংসদ তথা প্রসার ভারতীর সাবেক সিইও জহর সরকারও। তিনি বলেন, ‘এটা প্রসার ভারতী নয়, এটা প্রচার ভারতী।’

যদিও লোগোর রং পরিবর্তনের সাথে রাজনীতির যোগাযোগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রসার ভারতীর বর্তমান সিইও গৌরব দ্বিবেদী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘লোগোতে উজ্জ্বল রং কেবল বাণিজ্যিক কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে, রাজনীতির সাথে এর কোনো যোগাযোগ নেই।’

গত বছরের জানুয়ারি মাসে ‘দূরদর্শন পোথিগাই’ টেলিভিশন চ্যানেলের নাম বদল করে ‘ডিডি তামিল’ করে দেয়া হয়।

সেই সময় এই বিষয় নিয়ে তুমুল বিতর্কও হয়েছিল। ডিডি তামিল লোগোও পরিবর্তন করে ‘গেরুয়া’ রং করা হয়েছে।

চলতি মাসের গোড়ার দিকে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন দূরদর্শনে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামের চলচ্চিত্রের সম্প্রচারের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এতে দেখানো ‘লাভ জিহাদ’ এবং ধর্মীয় মেরুকরণসহ একাধিক বিষয়ের কারণে এমনিতেই বিতর্কের কেন্দ্রতে ছিল এই চলচ্চিত্রটি। গল্পের পটভূমি ছিল কেরালা।

কেরালাতে ওই ছবিটি সম্প্রচারের বিরোধিতা করায় তিনি বলেছিলেন, ‘দূরদর্শনের উচিত অবিলম্বে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা, কারণ এর (ছবির) উদ্দেশ্য রাজ্যে ঘৃণা ছড়ানো। সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ দূরদর্শনের করা উচিত নয়।’

কিন্তু তা সত্ত্বেও গত ৫ এপ্রিল রাত ৮টায় দূরদর্শনে সম্প্রচার করা হয় এই ছবি। বিষয়টি থিতিয়ে যাওয়ার আগেই আরও একবার নতুন বিতর্ক শুরু হলো প্রসার ভারতীকে নিয়ে। এবার বিতর্ক ডিডি নিউজের লোগোর রং বদল নিয়ে।

নতুন লোগো সংক্রান্ত দূরদর্শনের ঘোষণা
দূরদর্শন ভারতের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। দূরদর্শনের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টের মাধ্যমে চ্যানেলের লোগোর রং পরিবর্তনের ঘোষণাও করা হয়েছিল।

ওই পোস্টে লেখা হয়েছিল ‘আমরা এখন নতুন অবতারে আসছি কিন্তু আমাদের নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। খবরের জগতে আগে কখনো দেখা যায়নি এমন একটা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন এবং নতুন ডিডি নিউজ উপভোগ করুন।’

সেই পোস্টে আরো উল্লেখ ছিল ‘দ্রুত খবরের বদলে সঠিক খবর, চাঞ্চল্যকর খবরের বদলে সত্য। দূরদর্শনের খবর সত্যের আশ্বাস দেয়।’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সামাজিক মাধ্যমে লোগো পরিবর্তনের বিষয়টির নিন্দা করেছেন।

তিনি লেখেন, ‘আমি অবাক হয়ে দেখছি যখন দেশজুড়ে সাধারণ নির্বাচন চলছে, তখন হঠাৎই দূরদর্শনের লোগোর রং বদলে গেরুয়া করে দেয়া হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং বেআইনি।’

এই ঘটনার সাথে বিজেপির যোগের বিষয় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নও করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘বিজেপির প্রতি সরকারি সম্প্রচার সংস্থার পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে অনেক কিছুই বলে এই পদক্ষেপ। ভোটের সময় গেরুয়া সমর্থনে এমন প্রচারের অনুমতি নির্বাচন কমিশন দিল কীভাবে? নির্বাচন কমিশনের উচিৎ অবিলম্বে এটা বন্ধ করা এবং দূরদর্শনের লোগোর পুরানো রং ফিরিয়ে আনা।’

প্রসার ভারতীর সাবেক সিইও জহর সরকারের মতে ‘ওই লোগো দেখে মনে হয় যেন কোনো বিশেষ দলের প্রচার করা হচ্ছে।’

জওহর সরকার ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রসার ভারতীর সিইও ছিলেন। বর্তমানে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য।

ডিডি নিউজের লোগোর রং বদলে গেরুয়া যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভারতের সরকারি সম্প্রচারক দূরদর্শনের ঐতিহাসিক লোগোতে গেরুয়া রং করা হয়েছে। একজন সাবেক সিইও হিসেবে আমি দূরদর্শনের গেরুয়াকরণকে উদ্বেগের সাথে দেখছি। এটা এখন আর প্রসার ভারতী নেই, এটা একটা বিশেষ দলের প্রচার ভারতী।’

একটা ভিডিওর মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে একই বার্তা জানিয়েছেন তিনি।

ওই ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে সরকারি চ্যানেল তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য এই রং বেছে নিয়েছে। সেটা কমলা বা অন্য কোনো রং করতে পারত। কিন্তু একে সাধারণত গেরুয়া বলা হয় এবং এটা একটা নির্দিষ্ট ধর্মের সাথে যুক্ত।’

জওহর সরকার বলেন, ‘এর সাথে সাথে দেশ, সরকার, দল, সংগঠন ও ধর্মের মধ্যে পার্থক্যকারী রেখাগুলো কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেল। লাখ লাখ মানুষ এটা দেখেন। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের রং ছড়ানোর জন্য এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করাটা ঠিক নয়। এখন আপনি বলতেই পারেন যে জাতীয় পতাকাতেও এই রং রয়েছে, তবে সেখানে অন্য রঙের সাথে এটা রয়েছে।’

দূরদর্শনের ‘গেরুয়াকরণ’ হচ্ছে?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দূরদর্শনে কর্মরত এক কর্মকর্তা কথা বলেছেন, ‘যখন দূরদর্শন শুরু হয়েছিল, তখন একে একটি ক্ষমতাসীন সরকারের চ্যানেলের ব্যানারে চালু হয়েছিল। কিন্তু সে সময় এখানকার কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারেননি যে এই চ্যানেলের উদ্দেশ্য কী এবং এর উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায় কী হবে।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘দূরদর্শন জনসাধারণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এর একটা কারণ ছিল সে সময় এত বড় অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না। ২০০০-এর দশকে বেসরকারি চ্যানেলগুলো আসতে শুরু করে এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করে। কিন্তু তখনো কেউ দূরদর্শনকে বদলানোর করার চেষ্টা করেনি। একের পর এক সরকার আসে কিন্তু কেউ এটা বুঝতে পারেনি। ঠিক যেভাবে বিএসএনএল (ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড)-এর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে শেষ করে দেয়া হয়েছে, দূরদর্শনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। দূরদর্শনে কী হচ্ছে তা জানার, শোনার কেউ নেই। এই কারণে পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় গুটিকয়েক মানুষের হাতে।’

‘পক্ষপাতের’ প্রসঙ্গটাকে একটা উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন তিনি।

ওই কর্মকর্তার কথায়, ‘যদি দূরদর্শনে নির্বাচনি প্রচারের কোনো ভিডিও আসে তাহলে সেখানে প্রত্যেককে সমান অধিকার দেয়া উচিত। কিন্তু ভিডিও যে রাজ্যে দেখানো যাচ্ছে, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যিনি বিরোধী দলের তাকে রাখা হচ্ছে সপ্তম স্থানে। অথচ একজন বিজেপি নেতা যিনি কোনো পদে নেই, তাকে তৃতীয় স্থানে রাখা হচ্ছে এবং (ভিডিওতে) বেশি সময়ও দেয়া হচ্ছে। এখানে সমতা কোথায়?’

তিনি অন্য একটি বিষয়েরও উল্লেখ করেছেন তিনি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট দলের লোককেই দূরদর্শনে চাকরি দেয়া হয়। এই একই ঘটনা ঘটছে ডিডি তামিলেও। সম্প্রতি এক সেলিব্রিটিকে একটি মেগা সিরিয়ালে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি এখন বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিছু কর্মচারী একতরফা পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ করছেন বটে কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। দূরদর্শনের উন্নতির জন্য আরো অনেক সৃজনশীল উপায় রয়েছে। এই জাতীয় গেরুয়াকরণের কোনো ব্যবহার নেই।’

গেরুয়াকরণকে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা
তামিলনাড়ু প্রগ্রেসিভ রাইটার্স আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধবন দিতসানিয়া বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় মিডিয়া পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন এটা কোথাও না কোথাও গেরুয়া হয়ে গিয়েছে।’

এ বিষয়ে আরো কয়েকটি উদাহরণের উল্লেখ করেছেন তিনি।

দিতসানিয়া বলেন,‘আইআরসিটিসি (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন)-এর মোবাইল অ্যাপ, বন্দে ভারত ট্রেন- এগুলো কিন্তু কয়েকটা মাত্র উদাহরণ। সর্বত্র গেরুয়া রং এনে গেরুয়াকরণকে স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করছে তারা। এটা অনেকটা তাদের পক্ষে বইয়ে লেখার মতো। যেমন সরকারি ব্যক্তিরা যখন কথা বলেন, তখন তারা জয় শ্রীরাম বলেন। তবে শুধুমাত্র দূরদর্শন নয়, আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখুন এই দশ বছরে কীভাবে এটা একটা মহাকাব্য হয়ে উঠেছে।’

সাম্প্রতিক জনসভায় দেয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের উল্লেখ করেছেন তিনি।

অধবন দিতসানিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, যিনি পদের মর্যাদা বজায় রাখার বদলে নির্বাচনি প্রচারে যাচ্ছেন তিনি বিরোধীদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তাদের সদস্যরা আমিষ খেয়েছেন, মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসেনির মতো বিষয় নিয়েও বলেছেন। এই পরিস্থিতিতে দূরদর্শনের লোগোর রং বদলে গেরুয়া হয়ে যাওয়াটা কিন্তু বড় বিষয় নয়।’

‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সম্প্রচার
প্রবীণ সাংবাদিক প্রিয়ান বলেন, ‘যখন আগে থেকেই দ্য কেরালা স্টোরি ছবির বিষয়টা আদালতে রয়েছে তখন সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শন সেটা সম্প্রচার করে ঠিক নির্বাচনের সময়। এতে নির্বাচন কমিশনও কিন্তু হতবাক হয়েছিল। তাই দূরদর্শনের এই নতুন অবতার কিন্তু অবশ্যই গেরুয়া অবতার।’

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এটা যে একটা বিশেষ শ্রেণি বিরোধী এবং সমাজবিরোধী ছবি তা জেনেও কেন সরকারি খবরের চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়েছিল? নির্বাচনি লাভের জন্য এই কাজ করতে গিয়ে দূরদর্শনের কি এটা জানা উচিৎ ছিল না যে তারা কোনো একটা পক্ষকে সমর্থন করছে?’

তার মতে যখন সংসদে গেরুয়া রংয়ে রাঙানো হয়েছে তখন দূরদর্শনের লোগোর গেরুয়া হয়ে ওঠাটা ‘সাধারণ’ বিষয়।

প্রিয়ানের কথায়, ‘প্রথম দফার ভোট শেষ হয়েছে। এখনো ছয় দফার ভোট বাকি। ওরা জনগণকে প্রভাবিত করার জন্য এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করবে আর বলবে যে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে এবং সংখ্যালঘু বিরোধী। ওরা এটাই জানে।’

দূরদর্শনের সিইও কী বলছেন?
প্রসার ভারতীর বর্তমান সিইও গৌরব দ্বিবেদী ডিডি-র লোগোর রং বদলের বিষয়ে যে ধরনের অভিযোগ উঠছে সেগুলো অস্বীকার করেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, নতুন লোগোটি কমলা রংয়ের, আর এই পরিবর্তন কোনো দল বা নির্দিষ্ট কোনো রংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটা কমলা। ছয়-সাত মাস আগে, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে, আমরা ডিডি ইন্ডিয়ার (ইংরেজি খবরের চ্যানেল) লোগো ওই একই রংয়ে আপডেট করেছিলাম। এরপর আমরা নতুন গ্রাফিক্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিই। ভিজ্যুয়াল এবং প্রযুক্তির স্তরে ডিডি নিউজের একটি নতুন অবতার শুরু করেছি আমরা। শুধু চ্যানেলের লোগো নয়, নতুন জায়গা, আধুনিক যন্ত্রপাতি, উপস্থাপনার নতুন ধরনসহ অনেক নতুন পরিবর্তন আনা হয়েছে।’

একইসাথে তিনি বলেছেন, ‘এর আগেও আমরা দূরদর্শনের লোগোতে নীল ও হলুদ রং ব্যবহার করেছি। লোগোতে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করা বিজ্ঞাপন কৌশলের অংশ। সুতরাং এই পরিবর্তনগুলো চ্যানেলের স্বার্থে। এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement