২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আসামে বেড়েছে মুসলমান, আদালতকে যে কারণ জানাল ভারত সরকার

আসামে মুসলিমদের ঈদ কেনাকাটা। - ছবি : বিবিসি

ভারতের গুয়াহাটি হাইকোর্টে চলমান এক মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসামে মুসলিম জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে এবং ‘সীমান্তের ওপার থেকে আসা’ লোকজনরাই এ জন্য দায়ী।

গত শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) ওই মামলার শুনানিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার দেব চৌধুরী আদালতে এই বক্তব্য পেশ করেন।

‘ভারতের এই অংশটিকে দেশের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আলাদা করার জন্যই’ এই ষড়যন্ত্র আঁটা হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আসামে যারা বিদেশী বা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ইতোমধ্যেই শনাক্ত হয়েছেন তাদের ডিপোর্টেশনের আগে ভারতে থাকাকালীন কী কী অধিকার প্রাপ্য, সেই সংক্রান্ত একটি মামলাতেই কেন্দ্র তাদের এই অবস্থান জানিয়েছে।

তবে দেশটির বহু আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার আইনজীবী কেন্দ্রীয় সরকারের এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

আসামের মুসলিম সিভিল সোসাইটির নেতৃস্থানীয়রা বলছেন, রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যা যদি বেড়েও থাকে তাহলে সেটার জন্য সীমান্তের অন্য দিক থেকে হওয়া অনুপ্রবেশ দায়ী – এরকম দাবির কোনো ভিত্তি নেই, প্রমাণও নেই।

তবে উল্টোদিকে কোনো কোনো আইনজীবী আবার মনে করেন, আসামে যে বছরের পর বছর ধরে বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটেছে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর খসড়া পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট।

‘আদালতে কেন্দ্রীয় সরকারের এই বক্তব্য সম্ভবত সেই উপলব্ধিরই প্রতিফলন,’ বিবিসিকে জানিয়েছেন তারা।

অবৈধ অনুপ্রবেশ বস্তুত আসামে বহু পুরনো ও স্পর্শকাতর একটি রাজনৈতিক ইস্যু।

টানা বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যে এনআরসি অভিযান চালানোর পরও সেই বিতর্কের কোনো মীমাংসা হয়নি – এখন আদালতে কেন্দ্রের এই অবস্থান সেই বিতর্কেই নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।

আদালতে কেন্দ্র যা বলেছে
যে মামলার সূত্র ধরে এই বিতর্ক সেটি আসলে ২০১৬ সালের। আসামের মরিগাঁও জেলার এক মুসলিম বাসিন্দার কাগজপত্রে বাবার নামে কিছু অসঙ্গতি ছিল – তার ভিত্তিতে জেলার পুলিশ সুপার একটি ‘রেফারেন্স রিপোর্ট’ দেন এবং আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তাকে ‘বিদেশী’ বলে চিহ্নিত করে।

তবে এই ব্যক্তিকে এখনো অন্য দেশে ডিপোর্ট করা যায়নি। ইতোমধ্যে ২০২২ সালে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল অন্য একটি মামলায় তাকে আটক করে।

এই আটকাদেশের বিরুদ্ধেই গুয়াহাটি হাইকোর্টে তিনি আপিল করেছেন এবং ট্রাইব্যুনাল যাদের ‘বিদেশী’ বলে শনাক্ত করেছে ভারতে থাকাকালীন তাদের কোন কোন অধিকার প্রাপ্য, সেই প্রশ্নেই এখন শুনানি চলছে।

গুয়াহাটি হাইকোর্টের বিচারপতি এ এম বুজর বড়ুয়া ও বিচারপতি রবিন ফুকনের বেঞ্চে ২৮ এপ্রিল এই মামলার শুনানিতেই রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য তুলে ধরেন ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার দেব চৌধুরী।

দেব চৌধুরী বলেন, ‘আদমশুমারির তথ্য বলছে, ১৯৫১ সাল থেকেই আসামে মুসলিমদের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে।’

‘এখানে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বাড়ছে বলেই এটা হচ্ছে তা কিন্তু নয়, বরং (সীমান্তের) অন্য পার থেকে তারা আসছে বলেই এই বিপুল বৃদ্ধি ঘটছে। আর প্রথমে এসেই তারা আশ্রয় নিচ্ছে রিজার্ভ (সংরক্ষিত) এলাকায়।’

‘ভারতের এই অংশটাকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য দেশের সাথে জুড়ে দিতেই এটা করা হয়েছে’, মন্তব্য করেন ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল।

আসাম লাগোয়া বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না করলেও ‘অন্য পার’ বলতে তিনি কোথাকার কথা বোঝাতে চেয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্টই।

ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল আরো বলেন, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা যে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করেছিল, তখন থেকেই মুসলিমদের আসামে এনে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।

‘ব্রিটিশরা তাদের এনে আসামের চরাঞ্চলে বিভিন্ন নদী বরাবর বসানোর ব্যবস্থা করে। তখন মুসলিমরা কোন এলাকায় থাকবে তার জন্য একটা লাইনও টানা হয়েছিল, যেটাকে বলা হতো ইনার লাইন।’

‘মুসলিমরা সেখানেই বসতি করে থাকতে শুরু করে। কিন্তু তাদের সেই থাকার কোনো আইনগত সাপোর্ট ছিল না, কারণ ইনার লাইনের অস্তিত্ব ছিল শুধু কাগজেই,’ আদালতকে জানান তিনি।

‘বিদেশী’ হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর যাদের ডিপোর্টেশন এখনো সম্ভব হয়নি, তাদের সংবিধানের ২১ নম্বর আর্টিক্যাল অনুসারে কেবলমাত্র ‘রাইট টু লাইফ’ বা ‘জীবনের অধিকার’ আছে বলেও মতামত দেয় কেন্দ্র।

ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল আরো যুক্তি দেন, এই চিহ্নিত বিদেশীরা যদি আগে কোনো জমির কেনাবেচা বা লেনদেন করে থাকেন তাহলে সেটাও বাতিল বলে গণ্য হবে। সেই জমি তখন রাষ্ট্রের হেফাজতে চলে আসবে, ক্রেতা তা ভোগ করতে পারবেন না।

‘কেন্দ্রের দাবির ভিত্তি নেই’
গুয়াহাটি হাইকোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের এই বক্তব্যকে দেশের একাধিক প্রথম সারির আইনজীবী ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন।

বিবিসিকে তারা অনেকেই বলেছেন, আসামে এমন সংবেদনশীল একটি ইস্যুতে রাষ্ট্রপক্ষের কাছ থেকে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য প্রত্যাশিত ছিল না। ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোনও প্রমাণ দেননি, সেটাও তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

তবে মামলার সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকায় কিংবা বিষয়টি ‘বিচারাধীন’ থাকায় তারা অনেকেই প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন।

তবে গুয়াহাটি হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও আসামে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির উপদেষ্টা হাফিজ রশিদ চৌধুরীকে বিবিসি বাংলাকে পরিষ্কার বলেছেন, ‘অনুপ্রবেশের কারণে আসামে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে এই দাবির বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই!’

তিনি বলেন, ‘তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই রাজ্যে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে তাহলে সেটা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অভাবে বা অন্য কোনো কারণে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে মুসলিমরা তাদের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন এই তথ্য কেন্দ্র কোথায় পেল?’

১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে নাগরিকত্ব পাওয়ার কাট-অফ তারিখ হিসেবে ধরা হয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয়, ওই তারিখের আগে যারা রাজ্যে এসেছেন তারাই ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন এবং সেই মর্মে দেশের নাগরিকত্ব আইনও সংশোধন করা হয়।

এখন এই ন্যারেটিভকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেই মনে করছেন হাফিজ রশিদ চৌধুরী।

তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭১ সালের আদমশুমারির ১০ বছর পর ১৯৮১ সালে সারা ভারতে আবার যে আদমশুমারি হয়, সেটা কিন্তু আসামে হতে পারেনি। আসামে ১৯৭১ সালের পর সেন্সাস হয়েছিল পুরো ২০ বছর পর, সেই ১৯৯১ সালে।’

‘এখন একাত্তরে মেঘালয় বা অরুণাচল প্রদেশের মতো অনেক রাজ্যই আসামের অংশ ছিল, যেখানে মুসলিমদের সংখ্যা বরাবরই খুব কম। ২০ বছর পর আবার যখন সেন্সাস হলো ততদিনে মেঘালয় বা অরুণাচলকে আসাম থেকে কেটে বাদ দিয়ে আলাদা রাজ্য করা হয়েছে।’

‘ফলে ’৯১ সালের সেন্সাসে আসামে মুসলিমদের আনুপাতিক জনসংখ্যা যে বেড়ে গিয়েছিল তাতে তাই আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই।’

মুসলিমদের সেই সংখ্যাবৃদ্ধিকেই এখন স্রেফ রাজনৈতিক কারণে অনুপ্রবেশের ‘স্পিন’ দিয়ে পেশ করা হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা অনেকে মনে করছেন।

‘অনুপ্রবেশ একটা বাস্তবতা’
আসাম তথা ভারতের বহু বিশ্লেষকই কিন্তু মনে করেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ আসামের ক্ষেত্রে একটা বিরাট সমস্যা এবং সেটাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শুভদীপ রায় যেমন বলছিলেন, ভারতের শীর্ষ আদালতও কিন্তু এই পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিয়েছে।

বিবিসি বাংলাকে শুভদীপ রায় বলেন, ‘২০০৫ সালে সর্বানন্দ সোনোওয়াল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার বলেছিল আসাম বৈদেশিক আগ্রাসনের ভিকটিম।’

‘সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে অভিবাসনের কারণেই আসামে জনসংখ্যার চরিত্র বদলে গেছে বলেও বিচারপতিরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।’

বস্তুত ওই মামলার জেরেই পরে আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরির কাজ শুরু হয়, যা ‘এনআরসি অভিযান’ নামেও পরিচিত।

শুভদীপ রায় বলেন, ‘এনআরসি-তে প্রথমে আসামের মোট ৪০ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়ে, যারা নিজেদের বৈধ নাগরিকত্বের দাবির পক্ষে ঠিকঠাক কাগজপত্র পেশ করতে পারেননি। পরে তাদের আপিলের ভিত্তিতে সংখ্যাটা ১৯ লাখে নেমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু এটাও কোনো চূড়ান্ত পরিসংখ্যান নয়।’

‘তবে ১৯ লাখ ধরে নিলেও বলতেই হবে ৩ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার রাজ্যে আসামে অন্তত ৬ শতাংশ বাসিন্দাই ভারতের বৈধ নাগরিক নন – তারা অবশ্যই অনুপ্রবেশকারী,’ বলছিলেন শুভদীপ রায়।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্র নই। কিন্তু আমার ধারণা আদালতে ডেপুটি সলিসিটর জেনারেলের বক্তব্যে আসামের এই বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে।’

গুয়াহাটি হাইকোর্টে এই গুরুত্বপূর্ণ মামলার পরবর্তী শুনানি হবে মঙ্গলবার (২ মে) এবং তারপর থেকে প্রতিদিন শুনানি চলবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement