২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ফেরদৌস আহমদ কোরায়শী

ফেরদৌস আহমদ কোরায়শী - ফাইল ছবি

ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ড. ফেরদৌস আহমদ কোরায়শী। বড় নেতা হয়েও তিনি ‘কিংস পার্টি’র বদনাম নিয়ে দেহত্যাগ করেন কয়েক বছর আগে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন একদিন বাসে করে যাচ্ছিলাম লক্ষ্মীপুর পার হয়ে চাঁদপুরের দিকে। পথে দাগনভূঁঞা বাজারে রাস্তার ওপর ড. কোরায়শীর কয়েকটি পোস্টার দেখলাম। তার ছবি ছিল কিনা মনে নেই। তবে তিনি সেই ইলেকশনে জেতেননি।

ফেরদৌস কোরায়শীর জন্ম বর্তমান দাগনভূঁঞা উপজেলায় (সাবেক ফেনী সদর উপজেলা)। তার বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি চট্টগ্রামে বড় হয়েছেন, লেখাপড়াও সেখানে। তিনি ও আ ফ ম মাহবুবুল হক চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ফেরদৌস আহমদ কোরায়শীর ভাইদের মধ্যে সাবের আহমদ আসগরী জাসদ নেতা এবং সাপ্তাহিক হলিডের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ছিলেন। কয়েকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও আসগরী জাসদ থেকে জিততে পারেননি। আরেক ভাই জাফর আহমদ হানাফী লোকসংস্কৃতি বিশারদ এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপজাতীয় কালচারাল একাডেমির পরিচালক ছিলেন। সবচেয়ে ছোট ভাই, ইকবাল আহমদ সিদ্দিকী ছিলেন ছাত্রনেতা। তার এক ছোটবান ছিলেন কাস্টমসের কর্মকর্তা। তিনি জাতীয় মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের হাতেগোনা যে ক’জন ছাত্রনেতা পাশ্চাত্য থেকে ডক্টরেট করেন, ফেরদৌস কোরায়শী তাদের অন্যতম। এদিক দিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মধ্যে তিনি রেকর্ড করেছেন। তিনি খুব সম্ভবত তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি থেকে ডক্টরেট নিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে।

পরে তিনি ছিলেন বিএনপির সহকারী মহাসচিব। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয় ঐক্যের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং অল্প দিনেই জিয়ার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। নিজ আসনে নির্বাচনে না জিতলেও তিনি তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা হয়েছিলেন। জিয়া হত্যার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। তখন ফেরদৌস কোরায়শী দেশ ছেড়ে ইউরোপে চলে যান। ১৯৮৩ সালের শেষদিকে দেশে ফেরেন।

এ সময়ের কথা। এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেদিন আহত হন পুলিশের হাতে, সেদিনই আমার সাংবাদিক জীবনে রিপোর্টার হিসেবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। পুলিশের টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজে আমরা কতিপয় সাংবাদিক আহত হয়েছিলাম। সেদিন পল্টন মোড়ে বাসস (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) অফিসে ছুটে যাই আত্মরক্ষার জন্য। সেখানেই প্রথমে দেখা হয় ফেরদৌস কোয়ায়শীর সাথে। তিনি আরো অনেকের সাথে বালতির ময়লা পানি দিয়ে চোখ ধুচ্ছিলেন। তিনি আগে থেকেই বাসস অফিসে ছিলেন কিনা, জানি না।

রাজনীতিতে ড. ফেরদৌস কোরায়শী পরে আর সক্রিয় হননি। ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হিসেবে বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্য ছিল তার। তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে, ঐতিহাসিক মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত তার সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক দেশবাংলা’র মাধ্যমে। এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি মুজিব আমলে বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বিরোধী দলের মুখপত্র হিসেবে। পত্রিকাটি নিউজপ্রিন্টে ছাপা হতো এবং সাইজেও বড় ছিল না, কিন্তু জনপ্রিয় ছিল। এর দু’-একজন সাংবাদিক (রেজাউল হক সরোজ তাদের একজন) পরবর্তীকালে নাম করেছিলেন রিপোর্টার হিসেবে। পত্রিকাটি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপের মুখপত্রের মতো ছিল। ফেরদৌস কোরায়শী ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে তোফায়েল আহমেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বড় নেতা। তিনি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব হয়েছিলেন সংসদ সদস্য হয়ে এবং পরে তার বিশেষ সহকারীও হয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায়।
ফেরদৌস কোরায়শী ১৯৬৯ সালে কবি আল মুজাহিদীর নেতৃত্বে দলত্যাগ করেন। তখন তার সাথে ছিলেন আরো কয়েকজন ছাত্রনেতা। তারা মরহুম আতাউর রহমান খান, মরহুম অলি আহাদ এবং মরহুমা আমেনা বেগমের জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগে (এনপিএল) যোগ দেন। এ দলের অন্যান্য নেতার মধ্যে ছিলেন শাহ আজিজ, আশরাফ হোসেন (সাবেক বিএনপি নেতা), ইকবাল আনসারী এবং আনিসুর রহমান। ফেরদৌস কোরায়শী বর্তমানে প্রবাসী শফিক রেহমান সম্পাদিত বহুল প্রচারিত ‘সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে’ কলাম লিখতেন নিয়মিত। এতে তিনি ‘ভূমিপুত্র’ কথাটি রাজনৈতিক কলামে ব্যবহার করেছিলেন এই মাটির সন্তানদের বোঝাতে। ফেরদৌস কোরায়শী আমাদের জাতিসত্তা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় পরিচিতি প্রভৃতি নিয়ে লিখেছেন।

কিন্তু ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত কেন্দ্রীয় অভ্যুত্থানের পর তার বিতর্কিত ভূমিকা বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে। তিনি সেই সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতি পান। কিংস পার্টির এই অভিশাপ তিনি আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন। তার মধ্যে অহঙ্কারবোধ ছিল না। এমনকি, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও তার হাতে গড়া ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন হলেও তিনি কোনো বিশেষ সমাদর পাননি।
দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দীর্ঘদিন অনাদরে অবহেলায় পড়ে থেকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার স্ত্রীর আবেদনেও ক্ষমতাসীন দলের কেউ সাড়া দেয়নি। ফলে তাকে বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়নি সুচিকিৎসার জন্য। মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা-নেত্রী শোক জানিয়েছেন বলেও মনে পড়ে না।


আরো সংবাদ



premium cement