২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ইন্দোনেশিয়ায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন

ইন্দোনেশিয়ায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন - ফাইল ছবি

জোকো উইদোদো ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট। দেশের রাজনীতিতে তিনি প্রতিনিধিত্বকারী এক ব্যক্তিত্ব। নদী তীরবর্তী বস্তিতে আসবাবপত্র বিক্রেতার সাধারণ জীবন থেকে উঠে আসা জোকো উইদোদোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার যাত্রা ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের স্পন্দন তুলে ধরেছে।

দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্সিতে তিনি অবকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। তার প্রশাসন বিশাল দ্বীপপুঞ্জজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষায় বিনিয়োগ ও ছোট ব্যবসায়ের প্রসারের দিকে মনোনিবেশ করেছে। জোকো উইদোদোর জনপ্রিয়তা বেশ তুঙ্গে থাকলেও মেয়াদসীমার কারণে তিনি পুনর্নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেননি। ইন্দোনেশিয়ার এই নির্বাচনে তার উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে সুহার্তোর একনায়কতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোও সুবিয়ান্তো এবং সাবেক প্রাদেশিক গভর্নর আনিস বাসবেদান ও গঞ্জার প্রাণোভোর মতো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোটের ফলাফল ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যৎ এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে ভাবমর্যাদা প্রকাশে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে পঞ্চমবারের মতো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। প্রায় ২০৫ মিলিয়ন যোগ্য ভোটারসহ ১৭ হাজার দ্বীপ ও ২৭০ মিলিয়নেরও বেশি লোকের এই বিস্তৃত দ্বীপপুঞ্জটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণতন্ত্রের একটি দুর্গ বলা যায়।

উইদোদোর উত্তরসূরি কে হবেন সে প্রশ্ন থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে তিনজন বেশ অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব রাজনীতিক। তিনি কারো পক্ষে প্রচারণায় নামেননি, তবে জনগণ তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোও সুবিয়ান্তোর প্রতি নীরব সমর্থন রয়েছে বলে মনে করেন।

ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনে প্রথম দফায় কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে আগামী ২৬ জুন শীর্ষ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে রানঅফ হওয়ার বিধান রয়েছে। আইন প্রণয়নের লড়াই প্রায় ২০ হাজার জাতীয়, প্রাদেশিক ও জেলা সংসদীয় পদের জন্য কয়েক হাজার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৫৮০ আসনের জাতীয় সংসদে ১৮টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ১০ হাজার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলগুলোকে অবশ্যই তাদের দলীয় তালিকায় কমপক্ষে প্রতিটি তৃতীয় পদে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মনোনয়নের জন্য একটি দল বা জোটকে জাতীয় সংসদের কমপক্ষে ২০ শতাংশ আসন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

ইন্দোনেশিয়ায় ১৭ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো নাগরিক ভোট দিতে পারেন। নিবন্ধিত ভোটারদের প্রায় ৫২ শতাংশ তরুণ, ৪০ বছরের কম বয়সি। উল্লেখযোগ্য অংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। এবার প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণায় তরুণদের টার্গেট করেছেন। তরুণ প্রজন্মের পছন্দ ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পুলিশ ও সেনা সদস্যদের ভোট দিতে নিষেধ করা হয়েছে, কিন্তু তাদের পরিবার ভোট দিতে পারছে। তিনটি টাইম জোনের আট লাখ ২০ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র সকাল ৭টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত খোলা ছিল। প্রবাসী ইন্দোনেশীয়রা ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বের তিন হাজার ভোটকেন্দ্রে বা ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন।

কিছু পণ্ডিত দমননীতি, রক্ষণশীলতা ও ক্রমবর্ধমান ইসলামী মতবাদের সাথে ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও তা আতঙ্কগ্রস্ত হবার মতো এমন কোনো তথ্য বের হয়নি। দেখা যায়, ভোটাররা তাদের প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ও কল্যাণ কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রার্থীদের মূল্যায়ন করেছেন। এবারের ভোটে অভিজ্ঞ ও বয়স্ক নেতৃত্বকেও জনগণ সম্মান দেখিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ইন্দোনেশিয়া একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যা ঐতিহ্য এবং অগ্রগতি, বৈচিত্র্য এবং ঐক্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছে।

ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় এক দিনের নির্বাচন। তাই এটি এক বিশাল কাজ। এখানে ১৭ হাজারেরও বেশি দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে এবং পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান দূরত্ব! ২৫ বছর আগে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর থেকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পরীক্ষা সফলতার সাথে চলেছে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি জোকোবি বা জোকো উইদোদো গত দশকে ২৭০ মিলিয়ন মানুষের খনিজসমৃদ্ধ গ্রুপ অব-২০ বা জি-২০ অর্থনীতিতে স্থিতিশীল বৃদ্ধি এবং আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা লক্ষ করে সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। বৈদ্যুতিক যানবাহন সরবরাহ চেইনে বহুজাতিকদের ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি জি-২০ সভাপতি হিসেবে পরিশ্রম করেছেন।

তারপরও ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জোকো উইদোদো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন মর্মে সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি তিনজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর কাউকেই স্পষ্টভাবে সমর্থন না করলেও বিতর্কিত প্রাক্তন বিশেষ বাহিনীর কমান্ডার প্রাবোও সুবিয়ান্তোর সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখা গেছে এবং তার বড় ছেলে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে একই টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। গত সপ্তাহে দুটি জনমত জরিপে ধারণা করা হয়েছিল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোও, যিনি তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, বুধবার তিনি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন এবং তিনি এক প্রচেষ্টায় জয়ী হবেন। প্রতিদ্বন্দ্বী আনিস বাসবেদান ও গাঞ্জার প্রাণোভো যথাক্রমে ২৭ ও ৩১ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে দেখা যায় জনমত জরিপ সত্য হয়েছে।

প্রাবোওর প্রতি জোকো উইদোদোর মৌন সমর্থনের কারণে তিনি নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। ইন্দোনেশিয়ায়, ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতিরা প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে পারেন, তবে শর্ত থাকে যে, তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করবেন না এবং এটি করার জন্য অবশ্যই সরকারি ছুটি নিতে হয়। ক্ষমতাসীনরা সাধারণত নিরপেক্ষ থাকেন, এবারো তাই। জোকো উইদোদোর অধীনে গণতান্ত্রিক পশ্চাৎপসারণের প্রতিবাদে ১২ ফেব্রুয়ারি শত শত শিক্ষার্থী রাস্তায় শোরগোল করে বিক্ষোভ করেছে। ১৯৯৮ সালে, বিশাল ছাত্র বিক্ষোভ অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে, ফলে সাবেক শক্তিশালী নেতা সুহার্তোকে পতনের দিকে পরিচালিত করে এবং গণতন্ত্রের সূচনা করতে সহায়তা করে।

গণতন্ত্রের দিকে ইন্দোনেশিয়ার যাত্রা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ও চ্যালেঞ্জ। ইন্দোনেশিয়া সীমিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বসহ বহু শতাব্দী ধরে একটি ডাচ উপনিবেশ ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্দোনেশিয়া ১৯৪৫ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৪৫ সালের সংবিধানে সংসদীয় কাঠামোসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়। প্রথম রাষ্ট্রপতি সুকর্ন স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, সুকর্ন গাইডেড ডেমোক্র্যাসি চালু করেন, যা ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে। ১৯৬৫ সালের অভ্যুত্থানের ফলে সুহার্তোর উত্থান ঘটে, যিনি কর্তৃত্ববাদী নিউ অর্ডার শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সময়কালে, রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল এবং ভিন্ন মত দমন করা হয়েছিল।
১৯৯৮ সালের দাঙ্গা ও সুহার্তোর পতন গণতান্ত্রিক সংস্কারের সূচনা করে। ১৯৯৯ সালের নির্বাচন ছিল কয়েক দশকের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। তখন সংবিধান সংশোধন, নাগরিক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রসারিত হয়।

ইন্দোনেশিয়া গণতন্ত্রের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং এখন অনেক চলমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতি, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও আঞ্চলিক বৈষম্য। এ দেশে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ইন্দোনেশিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা জটিল, অগ্রগতি ও বিপর্যয়- উভয়ই দেখা যায়। জাতি আরো শক্তিশালী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের দিকে তার পথচলা অব্যাহত রেখেছে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাবোও সুবিয়ান্তো অনানুষ্ঠানিক ভোট গণনায় উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। দেশব্যাপী বেশ কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে জরিপকারীদের পরিচালিত দ্রুত গণনার ভিত্তিতে, প্রাবোও প্রায় ৫৭-৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কাছাকাছি ভোটও পাননি। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী আনিস বাসওয়াদান বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় কমবেশি ২৫.৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। আনুষ্ঠানিক ফলাফল পেতে আরো অপেক্ষা করতে হবে, ১৭ হাজার দ্বীপ থেকে লিখিত ফলাফল কম্পাইল করতে মাসখানেক লাগতে পারে।

ইন্দোনেশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল একই সাথে আনন্দ উদযাপন ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। অতীতের স্বৈরশাসনের সাথে সম্পৃক্ত মেরুকরণকারী প্রার্থী প্রাবোও সুবিয়ান্তো অনানুষ্ঠানিক ভোট গণনার ভিত্তিতে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন। দ্রুত গণনায় তার দৃঢ় জনসমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। তবে, নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ গণবিক্ষোভের সূত্রপাতও করেছে, বিক্ষোভকারীরা প্রাবোওর সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সমাবেশ শুরু করেছে। আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত সবই অনিশ্চিত। যেহেতু ইন্দোনেশিয়া এই জটিল সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে, তাই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করা ও নাগরিকদের উদ্বেগের সমাধান করে জাতির স্থিতিশীলতা আনা ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য মনে করা হচ্ছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement