২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অভিবাসী প্রসঙ্গে

অভিবাসী প্রসঙ্গে - নয়া দিগন্ত

১৮ ডিসেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের অধিকার এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি এর মুখ্য উদ্দেশ্য। বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে অভিবাসী ও তাদের পরিবারের অধিকার-মর্যাদা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ ২০০০ সাল থেকে দিনটিকে বিশ্বজুড়ে অভিবাসী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনে দিবসটিকে পালন করে।

সদ্য বিদায়ী বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্রবাসী কর্মীরা উন্নয়নের অংশীদার, সমুন্নত রাখব তাদের অধিকার’। যদিও নির্বাচনী ডামাডোলের এ দিবসের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া স্বাভাবিকভাবে সম্ভব হয়নি। দেশের জিডিপিতে ২০২২ সালে অভিবাসীদের অবদান ছিল ৫.৬৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে মাসিক ১.৮৫৩ বিলিয়ন ডলার হিসেবে বার্ষিক অবদান ছিল প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী বাংলাদেশীরা তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার জোগানদার হলেও তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে প্রবাসী কর্মীদের সামাজিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করার কর্মযোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের একাংশ দিয়ে তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন যা দৃশ্যমান হয়। তাদের প্রেরিত অর্থের একাংশ দিয়ে অভিবাসী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা যেতে পারে। যেখানে বিভিন্ন দেশে গমন-ইচ্ছুক অভিবাসীদের অভীষ্ট দেশের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সাধারণ আইন, বিপদে পড়লে কার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবেন এসব বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করা হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পেশা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে- কাঠের কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, ইলেকট্রিশিয়ান, গাড়ি চালনা প্রভৃতি বিষয়ে; ফলে প্রবাসে তাদের ভালো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অন্য সমস্যাগুলোর সাথে তারা সহজে খাপ খাওয়াতে পারে।

চাকরি সূত্রে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের অভিবাসী হওয়ায় এটার প্রয়োজনীয়তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ওখানে হাসপাতালে যোগ দেয়ার পরদিন আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো সকালে বিকালে সপ্তাহে তিন দিন রোগী দেখতে হবে। একদিন অপারেশন। একদিন অন কল ডিউটি। আমি যে রোগীদের দেখব সবাই আরবি ভাষাভাষী। তারা কি বলে আমি বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারি না, আমি যা বলি তারা বোঝে না। দু’জন নার্সের একজন ছিলেন মিসরীয়। অল্প বিস্তর ইংরেজি জানায় তার কাছে এক দুই করে মাস তিনেক সময়ে কাজ চালানোর মতো আরবি ভাষা শিখে রক্ষা। বাংলাদেশ থেকে যারা পৃথিবীর নানা দেশে অভিবাসী হয় তাদের বেশির ভাগ অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত, বেকার। তারা ইউরোপে পাড়ি জমান, অভিবাসী হন আফ্রিকায় অথবা মরুময় মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া থেকে তারা চরমভাবাপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের দেশগুলোতে পাড়ি জমান। ইউরোপে যেমন বরফ শীতল আবহাওয়ায় তাদের কাজ করতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যে তালু ফাটানো মরু হাওয়ায় তাদের জীবিকার তাগিদে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আবার দূরপ্রাচ্যে মালয়েশিয়ার পাম বনে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে দিন কাটাতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশ আবহাওয়া, ভাষা এবং খাদ্যের সাথে মিতালি করতে হয়। পরিণামে অনেকে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এসবের থোড়াই পরোয়া করে। অসুস্থ অবস্থায় একসময় স্বজনহীন পরিবেশে অনেকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। এর পরও শেষ নেই ভোগান্তির। লাশ দেশে আনার ক্ষেত্রে নানা ঝক্কি ঝামেলা। এদিকে দেশে আত্মীয় পরিজনের কান্না আর অসহায় প্রতীক্ষার যেন শেষ নেই। এ ব্যাপারে স্থানীয় দূতাবাসে কর্তৃপক্ষকে আরো কার্যকর ভূমিকা নেয়া দরকার।

৭০ হাজার ১৭০ নারী অভিবাসীদের দুঃখ দুর্দশা আরো চরমে। তারা পারেন না বাইরে যোগাযোগ করতে। গৃহকর্তার পরিবারের অত্যাচারে দেশে ফেরেন অনেকে লাশ হয়ে কেউবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে। অনেক অভিবাসী গন্তব্যে পৌঁছে দেখেন তাদের প্রতারিত করা হয়েছে। যে কাজের কথা বলে যে বেতনের প্রতিশ্রুতি, ভাতা ও সুবিধার কথা বলে তাদের আনা হয়েছে বাস্তব তার বিপরীত। সম্প্রতি দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকা জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় চার লাখ অভিবাসীর মধ্যে এক লাখ কোনো চাকরি পাননি। তারা এখন মালয়েশিয়ায় রাস্তায় রাস্তায় পাগলপ্রায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যাচ্ছেন। যেসব দালাল তাদের পাঠিয়েছিল; তারা এখন লাপাত্তা। এ ধরনের হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এক কোটি ৪৯ লাখ অভিবাসী (প্রধানমন্ত্রীর তথ্য জাতীয় সংসদে, জুলাই ২০২৩ সালে)। পৃথিবীর ১৭৬টি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় এসব অভিবাসীর কোনো সঠিক তথ্যভাণ্ডার নেই তথ্য মহাসড়কের যুগে। অথচ এটির প্রয়োজন সর্বাগ্রে। বিভিন্ন দেশের শ্রম বাজারের চাহিদা সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত সম্ভাব্য অভিবাসীদের জানানোর ব্যাপারেও রয়েছে দুর্বলতা।

বিদেশে যেসব বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছেন তাদের একটি সঠিক তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা প্রয়োজন সবার আগে। কোন দেশে কতজন রয়েছেন, তাদের কাজের ধরন, মজুরি, কর্মপরিবেশ, তাদের স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যকর বাসস্থান এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকা দরকার। জাতিসঙ্ঘের অভিবাসীসংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন কমিটির সাহায্য নেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে। এসব দেশস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসকে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার এ ক্ষেত্রে। দূতাবাস কর্তৃপক্ষের স্থানীয় দেশের উচ্চপর্যায়ে অভিবাসীদের ব্যাপারে নিয়মিত যোগাযোগ করা এবং প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা করা দরকার। অভিবাসন-প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের সমূলে উৎখাত করা উচিত। সব রকমের প্রক্রিয়া সরকারিভাবে হওয়া প্রয়োজন। এতে একদিকে অভিবাসীরা মানসিক শক্তি পাবেন, সাথে সাথে এ কর্মযোগে সরকারি কোষাগারে জমবে অর্থ। নারীকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যে দেশে মহিলাকর্মী পাঠানো হবে সে দেশের কর্তৃপক্ষ এবং নিয়োগকারীর সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাঠানো দরকার। এ ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়া সরকারি তত্ত্বাবধানে হওয়া দরকার যেন প্রয়োজনে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। সরকারিভাবে অভিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যার একটি খসড়া তালিকা তৈরি করে এর ভিত্তিতে কার্যক্রম হাতে নিলে অভিবাসীরা নিজেদের অসহায় মনে করবেন না। এতে দেশ ও সরকারের প্রতি বিশ্বাস আরো গভীর হবে। গভীর হবে দেশপ্রেম।

অভিবাসীরা দেশে ফেরার সময় তাদের বিমানবন্দরে স্বল্পতম সময়ে বের হওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। বাস্তবে বিমানবন্দরে তারা প্রায় সবাই হেনস্তার শিকার হন। এর আশু অবসান দরকার। দেশে ফিরে আসার পর অভিবাসীদের পুনর্বাসনে সরকারিভাবে সহযোগিতার কথা ভাবা প্রয়োজন। প্রায় দেখা যায়, অভিবাসীরা দেশে ফিরে এলে সঞ্চিত অর্থ বেহিসেবী খরচ করে ফেলেন। এটা যেন না হয় এজন্য প্রত্যাগত অভিবাসী পরামর্শ সেল জাতীয় ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। অভিবাসীরা আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় প্রাণভোমরা। এটি সচল রাখতে, সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, পরিকল্পনা এবং সাহায্য সহযোগিতা অতীব জরুরি।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement