২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্ম র ণ

হাকিম মাওলানা ইসমাঈল হিলালী

হাকিম মাওলানা ইসমাঈল হিলালী - ফাইল ছবি

বহুমুখী মেধা ও বিরল প্রতিভার অধিকারী, রোববার মাওলানা হাকিম ইসমাঈল হিলালীর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯১৭ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়নের তালগাঁও গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম দারুল উলূম মাদরাসা থেকে প্রথম বিভাগে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসা, মাযাহির উলূম সাহারানপূর ও দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়ন করেছেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষেèৗ ইউনানি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। একই সময়ে প্রখ্যাত কারি মাওলানা মাহবুব আলীর সান্নিধ্যে থেকে তিনি ‘কিরআতে সাব‘আ’ (সপ্ত পদ্ধতির কিরআত) এর ওপর ‘মুজাব্বিদ মাহির’ সনদ হাসিল করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম তিব্বিয়া কলেজের তিনি ছিলেন দীর্ঘ সময়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। তার অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা ও অধ্যবসায়ে কলেজটি ১৯৬৮ সালে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে অন্যতম শ্্েরষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক বোর্ডের সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান ইউনানি চিকিৎসক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। তদানীন্তন পাকিস্তানের তিব্বিয়া কলেজগুলোর সিলেবাস প্রণয়ন ও পরীক্ষা কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে তিনি দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। তার অভিজ্ঞতালব্ধ পরামর্শ, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ বাগ্মিতা সবাইকে বিমুগ্ধ করে রাখত। চট্টগ্রামে ‘খন্জর দাওয়াখানা’ নামে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খুলে সর্বস্তরের জনগণকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। ইউনানি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশে অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেফা-উল-মূলক হাকীম হাবীবুর রহমান ফাউন্ডেশন ২০০৫ সালে তাকে মরণোত্তর গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে।

তিনি ঐতিহ্যবাহী উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ পোষণ করতেন। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র লক্ষেèৗতে চার বছর অবস্থানকালে তার সৃজনশীল মানসকে পুষ্ট করতে সক্ষম হন। তাঁর কবিনাম (তাখাল্লুস) ছিল ‘খন্জর’। উপমহাদেশের বিশিষ্ট উর্দু কবি রঈস আমরূহী, হাফিজ জলন্ধরী, জিগর মুরাদাবাদী, মাহির আল কাদেরী, ড.‘আন্দালীব শাদানী, জোশ মালীহাবাদী, সুরূর বারাবান্্কভী, আসীফ আলাভী, কমর জালালভী, ‘বাবায়ে উর্দু’ আবদুল হক, অধ্যাপক সায়্যিদ ইকবাল আযীমের মতো উর্দু কবি ও সাহিত্যিকদের সাহচর্যের ফলে তার কাব্য প্রতিভার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। যেকোনো সময়ে এবং বিষয়ে তাৎক্ষণিক কবিতা রচনার বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল তার সহজাত। গীতিময়তার লালিত্যে সমৃদ্ধ এই কবিতাগুচ্ছের মূল উপজীব্য হচ্ছে নবীপ্রেম, রুহানিয়ত, সূফিতত্ত্ব, মানবপ্রেম ও ঐতিহ্যপ্রীতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের প্রাক্তন ডিন ড. শাব্বির আহমদ ইসমাঈল হিলালীর কাব্য প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘মরহুম হিলালী নান্দনিক আবেগের চেয়েও ‘জ্বালা’র তীব্রতম ‘দাগ’গুলোকে ইহজগতে সংগ্রামী তৎপরতার ফলস্বরূপ পরকালের জন্য পুঁজি-সম্বল বলে মনে করতেন। গজলের বিষয়বস্তুর মধ্যে রোমান্টিকতা যে অনবদ্য গুণ, তা তিনি আধ্যাত্মিকতার ব্যঞ্জনায় রপ্ত করার প্রয়াসী ছিলেন। অর্থবহুল ব্যঞ্জনাগুলোকে প্রয়োগসিদ্ধ করে চিত্তবিনোদন এবং আধ্যাত্মিক ভাবালুতার সমন্বয় সাধন করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তিনি আপন কবিনামস্বরূপ হিলাল, খন্জর ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। বলাবাহুল্য ‘হিলাল’ নতুন চাঁদ বোঝায় যা বস্তুত ‘খন্জর’ বা তরবারির মতো। তার রচিত কবিতাগুলোতে ‘ভ্রু’ এর বহুল ব্যবহার দেখা যায়। লক্ষণীয়, প্রেমাস্পদের ‘ভ্রু’ যখন ‘ঘাতকের’ দ্যোতনায় ভাস্বর, তখন তার তাখাল্লুস ‘খনজর’ যথার্থ প্রতীতির চমক সৃষ্টি করে। গজলের অনবদ্য করুণ রস সৃষ্টি বৈপরীত্যের মধ্যেও অক্ষুণ্ন থাকে বলে এটা এত জনপ্রিয় ও সার্বজনীন।”

হাকিম হিলালী আনজুমানে তারাক্কীয়ে উর্দু (উর্দু উন্নয়ন সমিতি) এর চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এবং আনজুমানে তারাক্কীয়ে উর্দু ওয়া বাঙ্গালা মাওয়াখাতের (উর্দু বাংলা উন্নয়ন ভ্রাতৃসঙ্ঘ) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে (মোশায়েরা) প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করে তিনি তাক লাগিয়ে দিতে পারতেন। তার উদ্দীপনাপূর্ণ ও ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক উপস্থিতি মাহফিলকে প্রাণচঞ্চল ও সজীব করে তুলত। এই কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. ওয়াজাহাত ‘আন্দালীব শাদানী কবিতা পাঠের আসরে হোসেন হিলালীকে ‘রওনকে মাহফিল’ (আসরের শোভা) বলে আখ্যায়িত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত খন্জর দাওয়াখানা ছিল উর্দু কবি ও লেখকদের মিলন মেলা। তার গজল, হামদ, না‘আত এর অন্ত্যমিলযুক্ত চতুষ্পদী (রুবায়ী) ও ষড়্মাত্রিক (মুসাদ্দাস) কবিতা ও চরণ ছিল ছন্দোবদ্ধ ও গীতিময়। শব্দ চয়ন, বাক্যবিন্যাস, অনুপ্রাসের ব্যবহার ও উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বের কারণে তিনি বিশিষ্টতা অর্জন করতে সক্ষম হন। প্রবন্ধ সাহিত্যেও তার সকল পদচারণা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লাহোরের “মুশীরুল আতিব্বা”, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন হতে প্রকাশিত “দাওরে জাদীদ” এবং ঢাকার দৈনিক “পাসবান” পত্রিকায় ছাপা হলে বিদগ্ধ জনগোষ্ঠীর সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মরহুমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি ছিলেন অনবদ্য কারি, বিজ্ঞ হাকীম, দক্ষ আলিম, হৃদয়গ্রাহী আলোচক, তেজস্বী বক্তা, শক্তিমান লেখক, জনপ্রিয় কবি এবং সর্বোপরি মুসলিম জাগরণ ও উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। রাজনীতির ক্ষেত্রে অতীতে মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জননেতা মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সিলেটের গণভোটে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী ও বিখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন।

১৯৮৮ সালের ২৭ অক্টোবর ৭১ বছর বয়সে ইসমাঈল হিলালী গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিনি এক ছেলে ও তিন কন্যা রেখে যান। তার ছেলে নয়া দিগন্ত’র চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হেলাল হুমায়ূনও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। হেলাল ভাই চট্টগ্রাম ইউনানি মেডিক্যাল কলেজ পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। উভয়ের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি আল্লাহ তায়ালার দরবারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এম.ই.এস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement