০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দেশ জাতি রাষ্ট্র

এক-এগারোর আলামত

এক-এগারোর আলামত - নয়া দিগন্ত

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি কোন পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক ভাষ্যকার মহিউদ্দিন আহমেদ তা তার ‘এক-এগারো’ গ্রন্থে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এক-এগারোর নায়ক অথবা খলনায়ক জেনারেল মঈন তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছিলেন ২০০৭-এর মাঝামাঝি সময়। তার ভাষায়- ‘খুব দ্রুতই পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। বিশ্বের মানুষ দেখেছে রাস্তায় মানুষ মরছে। এমনটি কি চলতে দেয়া যায়?’ অথচ বাংলাদেশের সচেতন মানুষ মাত্রই জানে সেই পরিস্থিতি ছিল পরিকল্পিত, উদ্দেশ্য অভিসারী ও ষড়যন্ত্রমূলক। তিনি টাইমকে ‘বাংলাদেশের কপট, নির্বিচার, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন।’ এই খায়েশই প্রমাণ করে, তার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। তারই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ দশক ধরে এক নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদের সিন্দাবাদ জাতির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আছে।

মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষায়, ১১ জানুয়ারির ঘটনা এক-এগারোর নামে গণমাধ্যমে আলোচনা ও জন-আলোচনায় ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। আজো তা নানাভাবে তাড়া করে বেড়ায়। প্রশ্ন হলো, ‘এক-এগারো’ কি ষড়যন্ত্রের ফসল, নাকি এটি অনিবার্য ছিল। ওই সময় চোখের সামনেই অনেক কিছুই ঘটেছে, আবার অনেক কিছু ঘটেছে আড়ালে। সবাই সবটা জানে না। আর আমজনতার তো অনেক কিছুই অজানা।’ লেখকের এই অনুভূতির সাথে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। সেই সময়ের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আজকেও সে ধরনের আশঙ্কা কাক্সিক্ষত হতে পারে না।
বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে সঙ্ঘাতময় হয়ে উঠেছে তাতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সেই এক-এগারোর আলামতের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন। গত সপ্তাহে এক রাজনৈতিক সেমিনারে এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। তারা বলেন, দু’টি পক্ষের অনমনীয় অবস্থানের কারণে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল। ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে আবারো ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। (দৈনিক ইনকিলাব, ১৯ অক্টোবর ২০২৩) একজন প্রবীণ আমলা মন্তব্য করেন, এক-এগারো হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সমঝোতা না হওয়ার কারণে। সভায় বর্তমান সঙ্কট সমাধানে সংলাপকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।

বস্তুত চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণে অর্থবহ সংলাপই শেষ ভরসা মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা অভিমত প্রকাশ করেন, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদরা রাজি হবেন। আর এই উদ্যোগ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকেই নিতে হবে। উভয় পক্ষ থেকে শর্ত জুড়ে দিলে সংলাপ কখনোই অর্থবহ হবে না। এতে পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল ও সঙ্ঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসতে অনুরোধ জানিয়েছে। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট-এনডিআই ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট-আইআরআই সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর শেষে সংলাপের অনুরোধ জানান। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনসহ অংশীজনদের পাঁচটি সুপারিশ করেন তারা। প্রধান সুপারিশটি হলো সংলাপ। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, সংলাপ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনোই সফল হয়নি। মার্কিন দলের পর খোদ মার্কিন সরকার সংলাপে বসার আবারো আহ্বান জানিয়েছে। সুড়ঙ্গের অবশেষে আশার আলোর মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদের সংলাপের ইঙ্গিত দিলেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এতে আশার সঞ্চার হলো। আবার তা পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল। এ কারণে ওবায়দুল কাদের শর্তহীন সংলাপের ব্যাখ্যা দিলেন। বিএনপি শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি ও নির্বাচনকালীন সরকারকে যেকোনো আলোচনার পূর্বশর্ত বা ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি চাইছে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এরকম একটি পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষই রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে চাইছে!

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির এক দফা, ৩২টি দলের আন্দোলন সবই ভুয়া। এই দলটি নিজেই ভুয়া। সমাগত সমাবেশ উপলক্ষে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসতে শুরু করেছে। মির্জা ফখরুল তাদেরকে অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে আসতে বলেছেন। তারা ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান অবরোধ করার ষড়যন্ত্র করছেন। তাই ঢাকার হোটেলগুলোতে কোনো সিট খালি নেই। সব সিট তারা বুক করে ফেলেছে। নতুন বাড়ির খালি ফ্ল্যাট বুক করেছে। সেই ডিসেম্বরের মতো সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু এবার বিএনপির পরিণতি শাপলা চত্বরের থেকেও আরো করুণ হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৮ অক্টোবর সবাই আমরা জমায়েত হবো। বিএনপি চুরি করে প্রবেশ করছে। আমরা কি বসে বসে ললিপপ খাবো? যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ সবাই প্রস্তুত আছি। এবার অবরোধ করলে বিএনপি অবরোধ হয়ে যাবে। বিএনপিকে অবরোধ করতে হবে। তারা এবার পালানোর পথ পাবে না। তিনি আরো বলেন, ডিসেম্বরের চেয়ে এবার বিএনপির জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হবে।

শাসকদলের দ্বিতীয় ব্যক্তির এসব আস্ফালন কী প্রমাণ করে? কোনোরকম রাখঢাক না করেই তারা হেফাজতে ইসলামের পরিণতির কথা বলছে। যা প্রকাশ্য হত্যার হুমকি। অথচ হেফাজতে ইসলামের শত শত মানুষকে হত্যার দায় তারা এতদিন অস্বীকার করছিলেন। এখন শাসক দল গণহত্যার মতো হুমকি দিয়ে গণসমাবেশ বন্ধ করতে চাইছে। হেফাজতে ইসলামের সেই আন্দোলন যে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার সাথে দমন করা হয়েছে এখন আর তাদের সে সুযোগ নেই। ওই রকম কিছু করতে গেলে তারাই এবার উৎখাত হয়ে যাবে।

এদিকে বিএনপিও দুর্গাপূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। ১৮ অক্টোবর মহা জনসমাবেশের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে বিএনপির দ্বিতীয় আন্দোলন অধ্যায়। দাবি না মানলে তফসিল পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দেয়ার কথা বিএনপির। সমাগত পূজা উপলক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান করে কর্মসূচি আপাতত স্থগিত থাকবে। কিন্তু পূজার ছুটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আন্দোলনের তৃতীয় ও শেষ অধ্যায় শুরু হবে। এটিই হবে বিএনপির চূড়ান্ত কর্মসূচি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই সব কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। অবরোধ ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে অচল করে দেয়া হবে। দৃশ্যত আওয়ামী লীগকে এই মাস পর্যন্ত আলটিমেটাম দেয়া হলো। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, ১৮ অক্টোবর জনসভাটি হবে ঐতিহাসিক। এটি রাজনৈতিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। বিশেষ করে এই কর্মসূচি আওয়ামী নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙার কারণ হবে।

এই সময়ে আরো ঘটবে বহুল প্রত্যাশিত সব বিরোধী শক্তির একই দিনে, একই সময় সমাবেশ ও কর্মসূচি। দু’টি বৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একই ধরনের যুগপৎ কর্মসূচি প্রণয়ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ জোট গৃহীত কর্মসূচি একই দিনে, একই সাথে পালন করবে। অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দল ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় একই কর্মসূচি পালন করবে। এভাবে সূচিত একটি গণ-আন্দোলনের মুখে পলায়ন করবে আওয়ামী লীগ। এই আশা পোষণ করছে সাধারণ জনগণ। উল্লেখ্য, গণ-আন্দোলন ও গণবিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন অনিবার্য করে তোলা পুরোনো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় এই গণবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

প্রকৃত গণ-আন্দোলনে অবশেষে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে- এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু গণ-আন্দোলনকে বিপথগামী করে অথবা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যদি এটিকে ব্যাহত করার চেষ্টা করা হয় তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে। নেমে আসে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন। বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর ঘোষিত তিন জোটের অভিন্ন ঘোষণা কার্যকর হয়নি। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘটে ২৮ অক্টোবরের মতো লগি-বৈঠার তাণ্ডব। দেশী-বিদেশী চক্রান্তে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাগত আন্দোলনে অবশেষে জনগণ আশা করে একটি স্বচ্ছ, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মাধ্যমে অবসান ঘটবে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের। পুনঃ প্রতিষ্ঠা হবে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement